ট্রেন থেকে নামতেই দেখা হল তার সঙ্গে। একটা নীল টিশার্ট আর জিন্স পরে দাঁড়িয়ে। বললাম, আরে তুমি কোথায় ছিলে, তোমার টাকাটা দেওয়া হয়নি তো।
সে আমার হাতটা ধরে বলল, আরে দাদা, কাকু হাস্পাতালে আমি জানি, এই সময়ে তুমি ওসব কথা ছাড়ো। কাকু ফিরুক। তুমি দিও।
বাবা তখন আইসিউতে। কিন্তু আমার সাহস হল না তার আবেগকে সরিয়ে টাকাটা দিতে।
বাবা বাড়ি ফিরলেন। তাকে টাকাটাও দেওয়া গেল। সরাসরি না, একজনের হাতে পাঠালাম, নানা ব্যস্ততার জন্য। তাকে পাওয়া ভার।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল। খবরটা পাওয়ার পর প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও অতটা গভীরে বুঝিনি কিছু। কিন্তু দিন যত লাগল বুঝলাম আমার কিছু ঋণ রয়ে গেছে। আমার কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি, যে মানুষটার টাকাটা সব চাইতে বেশি দরকার সে-ই অতবড় কথাটা বলল। অত বড় মনের কথাটা। সেটা তার ব্যবসার টাকা। আমি হাস্পাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে, হালিশহর থেকে রোজ কলকাতায়, মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল তার কিছু পাওনা বাকি তার আমার কাছে।
টাকার হিসাব মিটে গেল, কিন্তু সেই সহমর্মিতার জন্য তাকে একটা বারও কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানালাম না। কৃতজ্ঞতার বোঝা বয়ে বেড়ানো তবু যায়, কিন্তু আমি যে কৃতজ্ঞ, সে অনুভবটা না জানাতে পারার অসহায়তা যে কি চূড়ান্ত অসহায়তা। আজ বুঝছি।
র্যাশেনালিটি - বইটা অসামান্য। আমরা র্যাশেনালিটি বলতে ঠিক কি বুঝি? আমাদের মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের দ্বন্দ্ব আসলে কি? মানুষ সত্যিই কতটা র্যাশেনাল? মানুষের অভিব্যক্তির ইতিহাস কি বলে?
রামকৃষ্ণদেব বলছেন, "নিজের নিজের মত নিয়ে আবার অহংকার কত!"
মত নিয়ে অহংকার? হ্যাঁ আছে তো। সেই ইগো, বায়াসনেস ইত্যাদির চাপে র্যাশেনাল হতে কতটা পারি আমরা আদতে? আর হৃদয়? বিষয়বুদ্ধি না, স্বার্থবুদ্ধি না, "কাঁচা আমি"র দাসত্ব না, এর বাইরে কি কিছু আছে? যদি না থাকে তবে আমাদের বোধের উৎস কি?
স্টিভেন পিনকার, আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক, আজব আজব বিষয়কে অনায়াসে সামনে নিয়ে আসেন। কিছু অচলায়তনে বাতাস লাগে।
সেদিনের সেই মানুষটার আমাকে সেই কথাটা বলাটা অবশ্যই হিসাবী বুদ্ধির কথা নয়, সে এমন এক বুদ্ধির কথা যাকে পরিমাপ করা যায় না, অনুভব করা যায়। রাসেলের ভাষায় "লাভ ইজ ওয়াইজ"। এই উইজডম তথা প্রজ্ঞা কি র্যাশেনালিটির বাইরে? নাকি তাকে ঘিরেই। মনোবিজ্ঞানী স্টিভেনের বিশ্লেষণের আলোতে সব বড় অদ্ভুত পরিকাঠামোতে দাঁড়িয়ে। স্পিনোজা বলেন, বোঝো বোঝো… না বুঝলে সব ধাঁধা। কে বোঝে স্পিনোজা? আমার সব অনুভব, সব বোঝাকে কে সুতোয় বেঁধে বেঁধে বোধের বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রজ্ঞায় জারিত করে? অভিব্যক্তি ধারার চালক কে? অ্যামিবা থেকে প্রজ্ঞার পথে এত এত শত নিউরোনের ভাষার দিশা দেখায় স্টিভেন। হাসে আর বলে, কিছু বুঝলা? যদি ভাবো সব বুঝেছ, তবে জেনো আদতে কিছুই বোঝোনি। আর যদি ভাবো কিচ্ছু বোঝোনি তবে তো ঘুমাচ্ছ। জাগো জাগো। জেগে দেখো জিবরাণের ভাষায়, মাত্র জানলাটা দিয়ে আকাশটা দেখছ, জানলার মাপে আকাশকে মেপো না। আর আকাশের মাপে জানলা কোনোদিন হবে না। জানো তো?
রামকৃষ্ণদেব খিলখিল করে হেসে বললেন, চিনির পাহাড়, পিঁপড়ে এক কণা মুখে নিয়ে ভাবছে একদিন পুরো পাহাড়টা নিয়ে যাবে।
বিস্মিত হও মন। বিস্মিত হও। আশ্চর্য হও। অহংকারকে ধরতে যেও না, সে আরেক অহং এর খেলা। রমণ মহর্ষি বলছেন, সে যেন চোর পুলিশ হয়ে চোরকে ধরছে। মন অহং এর উৎসে যাও, কে চালায়? খোঁজো। বাক্স খুলছে স্টিভেন। বিস্মিত হও। পুলকিত হও।