শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন কত ভোল্ট কারেন্ট উৎপন্ন হওয়ার ক্ষমতা রাখে মানুষের মন। কিন্তু সেই কারেন্টে ইতিহাসে কী কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার কোনো ডেটাবেস ওঁর ছিল না।
মানুষের মনের শুভশক্তি আর অশুভশক্তি দুই নিয়েই তিনি সচেতন ছিলেন। আর তাই যেখানে যেমন সেখানে তেমনের উপদেশও দিয়েছিলেন। এক প্রচণ্ড রাগী ক্ষুব্ধ সন্ন্যাসী এসে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত। তিনি ভয়ংকর তেজে, অহংকারের সঙ্গে ঠাকুরের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠাকুর হাত জোড় করে এসে সামনে দাঁড়ালেন। তিনি যা-ই বলেন ঠাকুর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যান। ঘরে এসে দেখলেন কী কী আছে ঠাকুরের ঘরে। ঠাকুর সব দেখতে দিলেন শুধু না, যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ ঠাকুর হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকলেন সহাস্য বদনে। পরে সেই সন্ন্যাসী চলে গেলে একজন ঠাকুরকে ঠাট্টা করে বললেন, তা সে সন্ন্যাসীতে তো আপনার খুব ভক্তি? ঠাকুর হেসে বললেন, সন্ন্যাসী মানুষ! কী দরকার চটিয়ে বল!
মানুষের মনে তেজ উৎপন্ন, বিষ উৎপন্ন হয় ঠাকুর সব জানতেন। কিন্তু মানুষের শুধু বেলচাই তো থাকে না সঙ্গে, ব্লটিংপেপারও থাকে। যদি কেউ এসেই বলে, “ওহে তোমার মধ্যে তো দেখছি দোষের খামতি নেই। এসো হে, আমার কাছে এক যাদু বেলচা আছে। তোমার সব দোষত্রুটি আমি সে বেলচা দিয়ে ছেঁচে ছেঁচে পরিষ্কার করে দিই।” এ মানুষ হল অল্পদর্শী মানুষ। তার কাছে একটা মানুষের দোষগুণের খাতা আছে। সে খালি মেলায় আর রাইট মার্ক আর ক্রস মার্ক দিয়ে যায়।
ব্লটিংপেপার মানুষ কিছুটা অন্যধারার। তারা শুষে নেয়। বদরক্ত, পুঁজ ইত্যাদি বেরোবেই। কিন্তু ধৈর্য ধরে সে শুষে নেয়। কারণ? ভালোবাসা। সে জানে তার মানুষকে বদলানোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু সহ্য করার ক্ষমতা আছে। অন্তত কিছুটা অবধি। “বৈষ্ণব জন তো তেনে কহিয়ে জে” গানে নরসি মেহেতা একটা চমৎকার লিখেছেন, “সকল লোক মান সহুনে বন্দে/ নিন্দা না করে কে নি রে”। সবাই কে সহ্য করে নাও, নিন্দা কোরো না।
সবাইকে সহ্য করে নাও? এও কী হয়? আরে ভাই আমি সব খাই মানে কি বিশ্বশুদ্ধ সব গিলে ফেলি? তা অবশ্যই নয়। যতটা পারি ততটার কথা। কিন্তু কেন করব? সেটাই আসল কথা। কারণ, ভালোবাসি বলে। কেমন ভালোবাসা? তার ভালো চাই বলে। কিন্তু তাকে শুধরাতে হবে না? না। একদম না। প্রত্যক্ষভাবে কাউকে শুধরাতে যাওয়ার মত গড়বড়ে কাজ খুব কম হয়। ভালোবাসা নেই, অথচ এসো তোমাকে শুধরাই। এ হয়?
একজন তান্ত্রিক গোছের মানুষ এসেছেন। তিনি বামাচারী। ঠাকুর বামাচার পছন্দ করেন না শুনে রেগে গিয়ে বললেন, কেন তুমি শিবের কলম মানবে না? ওটা কি পথ নয়?
ঠাকুর তর্কে গেলেন না। বললেন, আমার ভালো লাগে না। ব্যস। “আমার ভালো লাগে না।” “আমি বুঝিনি”। এর মধ্যে তো ঔদ্ধত্য নেই। আছে সরল স্বীকারোক্তি। নিজের জায়গাটা স্পষ্ট করে দেওয়া।
ঠাকুরের ভালোবাসা বৃন্দাবনলীলা চর্চিত ভালোবাসা না। খ্রীষ্টের “লাভ ইউর নেইবার অ্যাজ দাইসেল্ফ” না। ঠাকুরের ভালোবাসা পাশে ব্লটিংপেপারের মত দাঁড়ানো ভালোবাসা। গিরিশ মদের বোতল নিয়ে এসেছেন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। ঠাকুর তার মদের বোতল আগে সামলিয়ে রাখছেন। কী ঠিক সে বাচ্চাও বলতে পারে। কিন্তু কার পক্ষে কখন কোনটা সঠিক সময় সে নিয়ে কথা বলার, তার কোনো ফর্মুলা হয় না। যেমন খাঁটি চাষীই জানেন ক্ষেত কখন বীজ বপনের জন্য তৈরি।
এ বিষয়ে ঠাকুরের জীবনীতে উদাহরণ তত নেই, যতটা আছে মায়ের জীবনীতে। কিন্তু সে নিয়ে আলোচনা অন্য সময় করা যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আসবাব ছিল না। শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের তেমন কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। তাও মানুষ সে ঘরে ভিড় করে বসত। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট একটা মাদুর পেতে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়ত। এ কীসের জন্য? ওই এক ভালোবাসায় আটকে গিয়ে। যে ভালোবাসা ব্লটিংপেপারের শুধু শুষেই নিচ্ছে, শুষেই নিচ্ছে।
ঠাকুরের এ ব্রত নিয়ে তৈরি হল এক সন্ন্যাসী আর গৃহীর দল। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। শাস্ত্র, ঈশ্বর, ধর্ম সব আলোচনা হল। কিন্তু তার মূলে থাকল মানুষ আর তার মঙ্গলের কথা। কম্পাস ওটাই। মানুষের মঙ্গল। শান্তিতে, আনন্দে, গ্রহণশীলতায়। শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ আর তাঁদের ‘ফৌজ’ কোনোদিন কাউকে বলেননি, ফিরে যাও। দোষগুণ, ধর্ম-অধর্ম কথা নয়। ফিরে যেও না। যতদিকে যাও এই একটাই কথা - ফিরে যেও না। দুটো উদাহরণ দিয়ে শেষ করি।
এক অতি সাধারণ মানুষ এসেছেন ঠাকুরের কাছে অনেকদিন পর। ঠাকুর তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, হ্যাঁ গো, অনেক দিন পর এলে। তার চোখে জল। তাকে মনে রেখেছেন ঠাকুর?
ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদে অনেক কষ্ট দিয়েছেন ঠাকুরকে। আবার সেবাও করেছেন। কিছু কারণে দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যেও আসা বারণ।
একদিন দুপুরে ঠাকুর বসে আছেন ভক্তদের মধ্যমণি হয়ে। খবর এলো, হৃদে এসেছে দেখা করতে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠাকুর চললেন। হৃদেকে জিজ্ঞাসা করছেন গ্রামের খবর কী? চাষবাস কেমন হয়েছে?
হৃদে কাঁদছে। আপনকে ছেড়ে কষ্টে আছি। হৃদে কাঁদছে। ঠাকুরের চোখের জল গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ছে। কথামৃতকার অবাক হয়ে দেখছেন। ঠাকুর কার জন্য কাঁদছেন, যে মানুষ এত কষ্ট দিয়েছে, অপমান করেছে?
সব চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনে চোখের জল মন্ত্রশাস্ত্রের থেকেও মহার্ঘ্য। লোকে বলে তিনি মায়ের জন্য কেঁদেছেন। ভালো করে ওঁর জীবনী পড়লে জানা যায় কত মানুষের জন্যেও যে কেঁদেছেন সে হিসাব কে রাখে?