Skip to main content

বাসন্তীর পা ডুবে ছিল গঙ্গাজলে, হাত দুটো জড়ো করে রাখা ছিল কোলের কাছে। কার উদ্দেশ্যে হাত দুটো জড়ো করা, না জানে বাসন্তী, না জানে বাসন্তীর অন্তরাত্মা। গঙ্গার ওপার থেকে কালো মেঘ বাচ্চা ছেলের মত হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আকাশ ছেয়ে ফেলছে তখন। বাসন্তী জানে এখনি উঠতে হবে, উঠোনে কাপড়গুলো মেলা, বড়ি শুকোতে দেওয়া। বাসন্তী একাই থাকে। সারাজীবন কত পুরুষের সঙ্গ হয়েছে, বাসন্তী গোনে না আজকাল। ওতেই পেট চলেছে, জীবন চলেছে। এখন বাসন্তী একা।

বৃষ্টি শুরু হলো। বড় বড় ফোঁটা মাথায় পিঠে কাঁধে পড়তে শুরু করলো। বাসন্তী উঠতে যাবে, ফিরে দাঁড়াতেই পা লাগলো গোঁসাই'এর পায়ে। বাসন্তী চমকে উঠে বলল, আমি খেয়াল করিনি ঠাকুর, তুমি কখন এসে বসেছ, আমি সত্যিই দেখিনি ঠাকুর।

গোঁসাই হাসলো, বলল, আমরা তো খেয়াল করিই না রে, সে কখন এসে পাশে বসেছে… অপেক্ষা করছে গায়ে পা ঠেকার…..

বাসন্তী গোঁসাইকে প্রণাম করে একটু দূরে গিয়ে সিঁড়ির একটা কোনায় বসল। শাড়ি ভিজুক, বড়ি ভিজুক, ঘর বাড়ি উঠান সব ভিজুক, বাসন্তীর আজ বড় সৌভাগ্যের দিন, গোঁসাই এসে বসেছে পাশে।

বাসন্তী বললো, তুমি এখানে ঠাকুর?

গোঁসাই বলল, তুই বা হাত জোড় করে বসে ছিলি কেন? বলেই হো হো করে হেসে উঠে বলল, আরে না না, এমনিই এদিকে এসেছিলুম, তোকে তন্ময় হয়ে বসে থাকতে দেখে মনে একতারার ছড় বাজল... মনে হল তুই কোন একতারার সুর তুলে একা বসে আছিস শুনি... তাই আড়ি পাততে এসেছিলাম।

বাসন্তীর চোখ উপচে জল এলো, তা বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে সিঁড়ি বেয়ে গঙ্গার দিকে গেল নেমে। বাসন্তী বলল একতারা আর পেলাম কই ঠাকুর? হাজার জনের সুরে বাজতে বাজতে শরীর নষ্ট, মন নষ্ট, আত্মা নষ্ট... গোটা জীবনটা বাঁচতে গিয়ে নষ্ট হলাম ঠাকুর।

জোরে বৃষ্টি নেমেছে। গোঁসাই বলল, সংসার পেলি না, সন্তান পেলি না, নিজেকে ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে এই যে একা হয়ে গেলি সংসারে, সে কি তোর একার পাপে?... গোটা সমাজের… আর কোনো মানুষের কোনো দায় নেই? কেউ সাদা নয় রে মা… কেউ না….।

বাসন্তী হাসল, বলল, কিন্তু আমিই হলাম দাগী।

গোঁসাই বলল, দাগী বলেই তো গোবিন্দের দরজায় যেতে তোর কোনো বাধা নেই।

বাসন্তী দীর্ঘস্বাস ফেলল, বলল, মনে কোনো সুখ জন্মায় না গোঁসাই... আশা ভরসা কিছু জন্মায় না।

গোঁসাই বলল, তারও উপায় আছে।

বাসন্তী ডান হাতের চেটোয় বৃষ্টি ভেজা মুখটা পরিস্কার করে, গোঁসাইয়ের মুখের দিকে এই প্রথম সোজাসুজি তাকালো। গোঁসাইয়ের চোখ বন্ধ, বৃষ্টির জলে স্নান করে যাচ্ছে গোঁসাই... তার জন্য উপায় আছে? এখনো আছে!

গোঁসাই বললো, এমন একজনের কথা ভাব যাকে তুই সর্বান্তকরণে ভালোবেসেছিলি... যে তোর হয়নি... কিন্তু তুই তার হয়েছিলিস... মনে প্রাণে কোথাও বাধা ছিলো না।

বাসন্তী গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলল, এগারোটা বছর হলো... আজই তার চলে যাওয়ার দিন ঠাকুর... আমি শ্মশানে গিয়েছিলাম সেদিন, দূর থেকে তাকে দেখেছিলাম, সবাই ফিরে যাওয়ার পর একমুঠো ছাই ঘরে এনে, পিতলের ঘটিতে রেখে, আমার নতুন শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে ঘটির মুখ বন্ধ করে খাটের নীচে রেখেছিলাম ঠাকুর... আজও আছে...

গোঁসাই বললো, ওই তোর গোবিন্দ... আমরা বলি ভগবান সবার মধ্যে আছেন... কথাটা ভুল বলি রে... সবার মধ্যে যে আছে... সবার মধ্যে যাকে দেখিস... যাকে অনুভব করিস... সে'ই ভগবান... তাই সে বাঁধে না, মুক্ত করে। তোর সে মানুষটাকে তুই তো আজ আকাশে বাতাসে সর্বত্র অনুভব করিস... তার জন্যই তো হাত জোড় করে বসেছিলি... সে'ই তোর ভগবান।

গোঁসাই চলে গেল বাসন্তীর মাথায় হাত রেখে, যাওয়ার আগে বলে গেল, তন্ময় হতে শিখেছিস, আর কি চাই রে মা... গোটা জীবনের একটাই তো স্বাদ... আনন্দ... তন্ময় হতে পারা।

তখন গোটা গঙ্গা তন্ময় হয়ে বৃষ্টিস্নানে। বাসন্তী কেঁদে উঠল। তার অন্তরাত্মা বলল, বাসন্তী বাড়ি চল।