স্বর্গদ্বারের কাছে হোটেল। তিনতলায় আমাদের একটা ফোরবেড, দোতলায় বাকিদের ফোরবেড। আটজন বন্ধু পুরীতে পৌঁছালাম দুপুরে, বন্দে ভারতে। শনিবার সেকেণ্ড আগস্ট। কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম বৃষ্টি মাথায় করে। এখানে একেবারে শুকনো খটখটে। সঙ্গে ভীষণ হিউমিডিটি।
সবাই স্নানে গেল। আমি হোটেলে রয়ে গেলাম। আমার কিছু কাজ ছিল। আমরা হোটেলে ঢোকার আগেই লাঞ্চটা সেরে নিয়েছিলাম। আমি এককাপ কফি বানিয়ে কাজে বসলাম।
হঠাৎ ঠক্ করে একটা আওয়াজ হল। মনে হল এসি-র থেকে এলো। তাকালাম। না। বাইরের ঝুলবারান্দা থেকে এসেছে মনে হল। এদিকে ইদানীং খুব বাঁদরের উৎপাত বেড়েছে। তাই কী? দরজাটা খুলে বাইরে এলাম। গরম হাওয়ার হল্কা মুখে লাগল। ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম, আমার এক বন্ধুর মেলা টাওয়েলটা ক্লিপ থেকে খুলে ক্লিপশুদ্ধ নীচে পড়ে আছে। কীভাবে হল প্রশ্নটা একবার মাথায় এলেও আমল না দিয়ে আবার ঘরে চলে এলাম। কাজে ডুবে গেলাম।
=======
ঠিক হল দুপুরেই মন্দিরে যাব। আমাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে শঙ্করাচার্য মঠের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। যদিও ভালো গরম, তবু হাঁটতে ভালো লাগছে। একটু পর মহাপ্রভুর গম্ভীরার পাশ দিয়ে গেলাম। মন্দিরে যখন এলাম তখন সাড়ে তিনটে মত বাজে। অশ্বদ্বার দিয়ে ঢুকলাম। দেখলাম বড় বড় কুলার লাগিয়েছে। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া। মন্দির চত্ত্বরও বেশ ফাঁকাই। লাইনে দাঁড়াতে হল না। দর্শন হল। মন্দির চত্ত্বরেই ঝুলনের সাজসজ্জা চলছে। সে সব দেখতে দেখতে বাইরে এলাম। প্রধান দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই জায়গাটা বড় অদ্ভুত। সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রণাম করে। ওই যে দরজার জগন্নাথদেবের প্রতিভূ রাখা। পতিতপাবন। অনেকেই দু'হাত তুলে প্রণাম করছে। কেউ কেউ রাস্তায় মাথা ঠেকিয়ে। সেই রাস্তাতেই পাণ্ডা থুতু ফেলছে। আশ্চর্য লাগে। এইসব দেখছি হঠাৎ আমার একজন বন্ধু বলল, হোটেলে লিফটের মধ্যে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ টের পেলি?
আমি সাধারণত লিফট ব্যবহার করি না। বললাম, না তো। তবে ও বলতে মনে হল আমাদের টয়লেটে বিশ্রী একটা গন্ধ। আমি ঠিকই করেছিলাম রিসেপশানে বলে একটা ওডোনিল লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
=======
রাতে ডিনার সেরে যখন হোটেলে ঢুকলাম তখন সাড়ে দশটা। এবার আমাদের ছাদে কিছুক্ষণ আড্ডা হবে। কফি আড্ডা। একদিকে সমুদ্র দেখা যাবে আরেকদিকে জগন্নাথ মন্দিরের চূড়া। অপূর্ব লাগে। আমি ছাদে হাঁটছি আর গুনগুন করে গাইছি, “থকামন চলো জিবা / চকানয়ন দেখিবা”। মন্দিরের সামনে বেশ কিছু মহিলা গাইছিলেন। ভীষণ মিষ্টি সুরটা। ইউটিউবে দেখলাম নমিতা আগরওয়ালের গাওয়া।
একজন বন্ধু একটু দেরি করে উঠল। টয়েলেটে গিয়েছিল। এসেই আমাকে বলল, তুই তোর ব্যাগটা খাটের উপর খুলে রেখে গিয়েছিলি কেন? ল্যাপটপটা খোলা।
আমি কিছুক্ষণের জন্য ঘাবড়ে গেলাম। মনে মনে বললাম, আমার যদ্দূর মনে পড়ছে আমি তো সব গুছিয়েই খাটের পাশের টেবিলে রেখে বেরিয়েছিলাম। তবে?
ওকে কিছু বললাম না। বললাম, হয় তো তাড়াহুড়োয় ভুলে গেছি।
সবাই গল্পে মশগুল। আমার একটা অস্বস্তি হতে শুরু করল।
=======
রাতে সবাই যে যার রুমে শুতে চলে এলাম। আমি একদম ধারে। আমার দিকেই দরজা। পাশে সুইচবোর্ড। একটা গুডনাইট জ্বলছে। সবাই ক্লান্ত, কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই নাক ডাকার আওয়াজ পেতে লাগলাম। আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
হঠাৎ মনে হল পায়ের পাতায় ভীষণ ঠাণ্ডা কিছু একটা লাগল। চমকে উঠে বসলাম। মোবাইলের টর্চটা অন্ করলাম। তিনটে এগারো। কই কিছু নেই তো! ভাবার শক্তি নেই। এত ক্লান্তি আর ঘুমে জড়িয়ে আছে চোখ। উঠলাম। টয়লেটে যাব। টয়েলেটের আলোটা জ্বেলে শুয়েছিলাম? হবেও বা। রুমটা অন্ধকার। টয়লেট সেরে বাথরুমের আলোটা নিভিয়ে শুতে যাব, হঠাৎ কেমন খটকা লাগল। কী যেন একটা অস্বাভাবিক। কী? বুঝলাম, গুডনাইটের আলোটা দেখা যাচ্ছে না। নিভে গেল? যেই এগোতে যাব, হঠাৎ মনে হল একটা কালো কিছু সামনে থেকে সরে গেল। আমার সারা শরীর দিয়ে হিমশীতল কিছু একটা নেমে গেল। গলার কাছে চোকড হয়ে এল। হাত-পা অবশ। কাউকে ডাকব?
কোনো মতে এসে শুলাম। সারারাত ঘুম হল না।
=======
পরেরদিন ব্রেকফাস্টের পর হইহই করে সমুদ্রস্নান হল। অনেকবার মনে হল সবাইকে বলি, তারপর মনে হল থাক। কী দরকার দু'দিনের ছুটির আনন্দটাকে মাটি করে। দুপুরে খাওয়ার পর ঠিক হল এক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে বেরোব। কিন্তু আমার হোটেল রুমে ঢুকতে ইচ্ছাই করছিল না। অস্বস্তি হচ্ছে একটা। যা হোক সবাই একই রুমে খাটে, চেয়ারে, মেঝেতে ছড়িয়ে বসা হল। গল্প চলছে। হাসাহাসি হচ্ছে। আচমকা একজন বন্ধু আমার পাশে বসা বন্ধুকে বলল, বাবা, এতটা কাটলি কী করে?
সবাই তাকালাম। হাঁটুর নীচ থেকে প্রায় চার আঙুল মত আঁচড়। টাটকা না। ও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। বলল, এ বাবা… তাই ভাবছি জ্বালা করছে কেন….. মনে হয় ঝিনুকে? টিটেনাস নেব?
কেউ বলল, হ্যাঁ; কেউ বলল, না। কথা অন্যখাতে ঘুরে গেল। বিকেলে যখন সবাই বেরোলাম, ও আমার কাছে এসে একফাঁকে বলল, কাল রাতে হয়েছে জানিস। প্রথমে ভেবেছিলাম খাটের কোণায় লেগেছে। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, না, ঘুমের মধ্যে মনে হল কেউ পা-টা চেপে ধরেছিল। আমি ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি…. তুই কি কিছু ফিল করেছিস?
আমি বললাম, আরে না, সমুদ্রেই হবে।
=======
পরেরদিন রাতে ঘুম আসছে না। সবাই ঘুমাচ্ছে। আমি আর ও জেগে। বলল, হোটেলটা চেঞ্জ করবি? আমি জানি তুই কিছু ফিল করেছিস।
ও সিগারেট খায়। বলল, চল ছাদে যাই। ঘুম আসছে না। মোবাইলের টর্চটা অন্ করে রুমটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে বাইরে করিডোরে এলাম। হাঁটছি, হঠাৎ লিফটা ধড়াম করে উঠে দরজাটা খুলে গেল। সঙ্গে বিরাট আঁশটে গন্ধ। ও আমার হাত ধরে প্রায় চীৎকার করে উঠেছে… কী হচ্ছে রে এটা বলে…..
আমরা কোনোরকমে রুমে ঢুকে লক্ করে শুয়ে পড়লাম। গা-হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। পাশেই রাখা টেবিল থেকে জলটা এগিয়ে নেওয়ারও সামর্থ্য নেই।
=======
সারারাত জেগেই কাটালাম বলাই বাহুল্য। ওর জ্বর চলে এল ভোরের দিকে। একটু আলো ফুটতে সবাইকে ডাকলাম। রুমে সবাই এসে বসল। সবটা শুরু থেকে বললাম। আশ্চর্য হলাম আমাদের ফ্লোরে চারজনেই আলাদা আলাদা ভাবে কিছু না কিছু অনুভব করেছে। একজন বলল, আমি তোরা চলে যাওয়ার পর একটা কাজ করতে রুমে ছিলাম মনে আছে? আমি স্পষ্ট কয়েকবার টয়লেট থেকে অদ্ভুত আওয়াজ পেয়েছিলাম। তাই ল্যাপটপটা নিয়ে গিয়ে নীচের ডাইনিং-এ বসে কাজ করছিলাম।
আরেকজন বলল, যতবার লিফটে উঠেছে কোনো অজানা কারণে গা ভারী লেগেছে। অবশ লেগেছে।
প্রথমে ঠিক হল হোটেল চেঞ্জ করব। তারপর একজন বলল, আমরা যদি পুরো সেটটা রুম এক্সচেঞ্জ করি। তোরা ২০৫-এ চলে আয়। আমরা ৩০৫-এ যাই।
=======
তাই হল। পরের গোটা দিন বাইরে কাটালাম। কান্টিলো গেলাম নীলমাধব মন্দির দেখতে। কী অসামান্য জায়গা! নদীর ধারেই ছোটো পাহাড়। তার উপর মন্দির। নদীর ওপারে মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের সারি। এদিকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।
পুরী ফিরে এলাম। এবারে পুরী বেশ ফাঁকা ফাঁকা। কেমন একটা অস্বস্তিই লাগছে। ফিরে মন্দিরের সামনে থেকে সবাই ঘুরে এলাম। রাস্তায় যত কথা হচ্ছিল ফিরে আর কেউ তেমন কথা বলছি না কারোর সঙ্গে। চাপা উত্তেজনা চলছে সবার মধ্যে। সবাই সবাইকে ইজি রাখার চেষ্টা করছে।
=======
সাড়ে বারোটা নাগাদ ছাদ থেকে নামলাম সবাই। কথা মত আমরা ২০৫-এ চলে এলাম। ওরা ৩০৫-এ গেল। ঘরে এসে আলো নিভিয়ে শুলাম। কেউ ঘুমাচ্ছি না। ঘুম আসছে না। সামান্য আওয়াজ হলেই সতর্ক হয়ে যাচ্ছি। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। বারবার ফোন চেক করছি। রাত পৌনে দুটো হবে, দরজায় টোকা পেলাম। আমি ধড়মড় করে উঠে আলো জ্বাললাম। সবাই উঠে বসেছে। দরজাটা খুলে দেখি কেউ নেই। গোটা করিডোর ফাঁকা। শুধু বিকট আঁশটে গন্ধ একটা। গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। একজন বলল, উপরে যাবি? সবাই যে যার মুখের দিকে তাকিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। লিফটের সামনে দিয়ে পার হতেই লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ৩০২, ৩০৩, ৩০৪…. ৩০৫…. একি! রুমের দরজা খোলা। আলো-পাখা জ্বলছে। ওরা?
একজন বলল, ছাদে?
সবাই ছাদের সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগলাম। আবার লিফট পড়ল। এবার খোলা। বিশ্রী আঁশটে গন্ধ।
উপরে উঠে দেখি ওরা জড়সড় হয়ে সব বসে। আমাদের দেখেই বলল, ভাই এখনই এখান থেকে পালা। আমরা নীচে নামতে পারছি না। সিঁড়ির বাঁকের কাছেই কী বিশ্রী গন্ধ!
বাকি রাত কেউ কোনো কথা বললাম না। পরের দিন চেক আউট করে স্টেশানের পাশে একটা হোটেলে চলে এলাম। রাতে ট্রেন। সারাটাদিন বলতে গেলে স্টেশান চত্ত্বরেই কাটালাম।
ট্রেনে উঠলাম রাতে। মড়ার মত ঘুমালাম। বেলা আটটা নাগাদ শালিমার স্টেশানে নামলাম। এবং সত্যি বলতে কান্না পেয়ে গিয়েছিল আমাদের অনেকেরই। ফেরার সময় শিয়ালদায় আপ কল্যাণীতে বসে আছি। ফাঁকাই ট্রেন। বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী দেখেছিলি তোরা?
একজন বলতে শুরু করল, আমরা খাটেই বসেছিলাম সবাই। যে যার মোবাইলে ডুবে। হঠাৎ ও উঠল, বলল টয়লেট থেকে আসছি। দরজার কাছে গিয়ে দরজাটায় দুবার ধাক্কা দিল। খুলল না। জিজ্ঞাসা করল, কেউ গেছে নাকি? খাটে আমরা সবাই সবার দিকে তাকালাম, সবাই তো এখানেই। তবে? আমি উঠে গিয়ে দরজাটায় চাপ দিলাম, কী টাইট। ভাবলাম বর্ষাকালে দরজা বেড়ে এরকম তো হয়। কিন্তু এটা তো কাঠ না। ইতিমধ্যে আরেকজন এসে দরজায় চাপ দিতেই দরজাটা ধড়াম করে খুলে গেল, সারা ঘর তীব্র আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে গেল। আর মনে হল যেন কেউ যেন ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে গেল। ব্যস, আমরা আর রুমে থাকিনি।
ট্রেন ছাড়ল। আমাদের মধ্যে একজন বলল, দক্ষিণেশ্বর হয়ে ফিরি চল। আমরা সবাই বললাম, চল।