Skip to main content

দেবী সরস্বতী দাঁড়িয়ে। সামনে খিচুড়ির গামলা। ওদিকে বড় বড় বক্সে "মেরে মেহবুব মেরে সনম" গান হচ্ছে। নাচছে অনেকে।

ক'টা বাচ্চা কুকুর চাইছে রাস্তা পার হবে। এদিক থেকে ওদিক। কিন্তু যাবেটা কি করে? একে এতো আওয়াজ। তার উপর এত হল্লা। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে টোটো, রিক্সা, সাইকেল, বাইক। বাচ্চা চারটে। দু'পা এগোয়। চার পা পিছোয়। আবার দু'পা এগোয়।

এই পুরো ঘটনাটা চোখে পড়ল পাকুর। পাকুর সঙ্গে সরস্বতী'র কোনোদিন বনিবনা হয় না। তা নিয়ে পাকুরও মাথাব্যথা নেই, সরস্বতীরও না। পাকুদের বাড়ির গাছে কুলের অভাব কোনোদিন হয় না। ওদের পুকুরে হাঁস দিব্যি নির্ভয়ে সাঁতার কেটে বেড়ায়। এই সব দেখে পাকুর বিশ্বাস হয়েছে সরস্বতী যতই বিদ্যার দেবী হোন না কেন, রাগী দিদিমণি গোছের কেউ নন।

যা হোক। পাকুর সাহস আর বিক্রমের তুলনায় চেহারাটা বেড়ে ওঠেনি। বেশ কয়েকবার পাশ-ফেলের আলোছায়া পথে হেঁটে পাকু এখন নাইনে। চেহারা বেশ নাদুসনুদুস।

পাকু একটা ফাঁক খুঁজছে নৃত্যরত মানুষদের কোমর, পা-এর মাঝে একটা প্যাসেজ। কুকুরগুলোকে এদিকে আনলে দুটো খেতে পারবে। হ্যাঁ, খিচুড়িই। ওই একে ওকে দিতে গিয়ে যতটুকু পড়বে মাটিতে, ওইতেই ওদের হয়ে যাবে। অতটুকু তো পেট!

পাকু একবার সরস্বতীর দিকে তাকালো। মা ইশারা করে হাঁসটাকে দেখালো। পাকুর মাথায় অমনি একটা আইডিয়া খেলে গেল। হাঁসেদের মত অমন হেঁটে গেলেই তো হয়।

ব্যস। পাকু হাঁটু মুড়ে বসে এঁকেবেঁকে হাঁসের মত হাঁটতে শুরু করল। সবাই নাচে মত্ত। পায়ের কাছে, কোমরের কাছে যে একটা জলজ্যান্ত মানুষ যাচ্ছে অনেকেরই খেয়াল নেই। খেয়াল করছে শুধু ভুতো। এ পাড়ার সব চাইতে ভালো ছেলে। সে ভালো ছেলে হতে চায় না। কিন্তু তার আর উপায় নেই। স্কুলে ভালো নাম্বার পায়। ফার্স্ট হয়। তাই নিয়ে তার দুঃখও হয়। পাকুকে ওরকম যেতে দেখে তার যে কি ইচ্ছা করছে ওরকমভাবে নাচের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে। পাকুর সব কিছুই তার ভালো লাগে। সরস্বতী পুজোর আগে ছাদে ঘুরে ঘুরে কুল খায়। বেলা অবধি পুকুরে সাঁতার কাটে। অথচ সে কিছুই পারে না। কারণ সে ফার্স্টবয়। বড় হলে নাকি পারবে। কত বড় হবে? বাবাও কি করতে পারে পাকু যে গুলো করে? রাতদিন মায়ের মুখঝামটা খায়। বাবা তো ছাড়, ঠাকুর্দা তো বড় হতে হতে বুড়ো হয়ে গেল। সেও তো রাতদিন এই হয় মাফলার বাঁধছে, নয় হজমের ওষুধ খাচ্ছে। কেউ কি পাকুর মত হতে পেরেছে?

হঠাৎ কি মনে হল সরস্বতীর দিকে তাকালো। সরস্বতী তাকেও ইশারা করল, ঢুকে যা! ভুতো ঢুকে পড়।

পাকু দেখল, ওই নাচের ঠেলাঠেলির মধ্যে গুঁতো খেতে খেতে ভুতোও ঢুকছে। পাকু প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করেনি। ওর মা তো দু'বার জোরে হাওয়া দিলেই দশটা সোয়েটার পরিয়ে দেয় ভুতোকে। দু'বার বেশি পায়খানা করলেই ওষুধের দোকান থেকে এত মোটামোটা ট্যাবলেট নিয়ে এসে খাওয়ায়। সে কিনা!

ভুতো পাকুর কাছে এসে বলল, চ…. ওগুলোকে নিয়ে আসি।

পাকু আর ভুতো কিভাবে কুকুরছানাগুলোকে এই নৃত্যরত নরনারী পেরিয়ে ওপার থেকে খিচুড়ি পারে নিয়ে এলো সে বর্ণনা স্বয়ং গণেশও চার হাতে লিখে শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় না। যেন যুদ্ধক্ষেত্র। চারদিক থেকে গোলাগুলি চলছে। এর মধ্যে ভুতো আর পাকু আহত সৈন্যের মত কুকুরছানাগুলোকে একটা একটা করে এ পারে আনছে। কেউ পাছার ঠেলা মারছে। কেউ পায়ের পাড়া দিল হাতের উপর। সে এক কাণ্ড!

যা হোক। কুকুরছানাগুলো এপারে এসে মাটিতে পড়া খিচুড়ি মহোল্লাসে খেতে শুরু করল। ভুতো এক হাতা খিচুড়ি ফস্ করে মাটিতে ফেলে দিল। ভুতোর ঠাকুমা চেয়ারে বসেই হাউমাউ করে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তিনি ভীষণ আচারি মানুষ। ভুতো ভাবে ঠাকুমার পৈতে না হতেই এত আচারি, পৈতে হলে নিশ্চয়ই গঙ্গাজলের চৌবাচ্চা বানিয়ে চুবে থাকত রাতদিন। দৃশ্যটা কল্পনা করে একা একাই হেসে মরে ভুতো। ঠাকুমা পৈতে পরে গলা জলে চুবে আকাশের দিকে তাকিয়ে জপ করছে। আর ঠাকুর হনুমানের মত এ গাছ, সে গাছ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ধরা দিচ্ছে না। দিলেই তো জলে চুবিয়ে নকুলদানা খাওয়াবে। কার দু'বেলা নকুলদানা খেতে ভালো লাগে? ঠাকুর বলে কি মানুষ না!

যা হোক। নাচ শেষ হল। এবার সবাইকে বসিয়ে খাওয়ানো হবে। কিন্তু খিচুড়ির গামলা কই?

পাকু আর ভুতো ততক্ষণে রেলস্টেশানের কাছে। সেখানে অনেক বাচ্চা। মানুষের বাচ্চা। ভুতো বলেছে পাকুকে, ওদের খাওয়াবি? ব্যস, এসব কাজে পাকু তো সিদ্ধমহাপুরুষ। গামলা নিয়ে দৌড় আর দৌড়। পিছনে ছানাগুলো।

আশ্চর্য ঘটনা হল, সবাই সবটা জানার পর যতটা রাগ করবে ভুতো ভেবেছিল, কেউ করল না। ঠাকুমা শুধু সজল চোখে বলল, জামাটা ছেড়ে আসিস…. এঁটো তো!

আর পাকু! সে আছে, কি নেই এতটা ভাবার সময় কোথায় কারো! মা নেই তো!