লিও সিনেমায় কোনো ডোরেমন নেই। অতিপ্রাকৃত উপায়ে সমস্যার সমাধানের কোনো উপায় লিও জানে না। লিও স্কুলের কাঁচের বাক্সে রাখা পোষ্য। তার সঙ্গী একজন কচ্ছপ।
গল্পটা সোজা। কিন্তু হৃদয়কে ছোঁয়। লিও বাচ্চাদের সমস্যার সমাধান করে দরদ আর বাস্তবতা মিশিয়ে। নিজের সীমাবদ্ধতা আর নিজের প্রতিভাকে জানার জন্য নিজের মধ্যে যে দরদ আর বাস্তববোধ দরকার লিও বাচ্চাদের তা শেখায়। আর বলে প্রত্যেকে তোমরা জীবনে এমন লিওকে খুঁজে বার করো যার কাছে তোমরা মনের কথা খুলে বলতে পারো। সেই মনের কথা খুলে বলার মধ্যেই আছে সমাধান।
দীর্ঘদিন এই শিক্ষকতার সঙ্গে থেকে দেখেছি বাচ্চাদের যদি আমার পূর্বকল্পিত সরল-সোজা-অবোধ ট্যাগ লাগিয়ে না দেখি, বা হাড়বজ্জাত-গাঁটে গাঁটে শয়তানি ইত্যাদির চশমাতেও না দেখি, তবে গোটাগুটি তাদের দেখতে পাওয়া যায়। নইলে যা দেখতে চাই, শুনতে চাই, তাই দেখি, তাই শুনি।
বাচ্চাদের নিজেদের জটিলতা বা কমপ্লেক্সিটি থাকে। সেগুলো বাইরে থেকে যতটা সহজ মনে হয় আদতেও তা নয়। আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রা জীবনের অনেকদিক বাচ্চাদের সামনে অনেক আগেই খুলে ধরছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেগুলোকে নিজের বোধবুদ্ধিতে নিজের মত করে গ্রহণ করার শিক্ষা বা ক্ষমতা কোনোটাই তাদের থাকে না। ফলে অর্ধপাচ্য, অপাচ্য হয়ে মনের কোণে এমন সব জটিলতা সৃষ্টি করে বাইরে থেকে সেগুলোর নাগাল পাওয়া মুশকিল। অন্তত আপাত দৃষ্টিতে।
প্রথম কথা একটা আনজাস্টিফায়েড, আনরিজনবল অপরাধবোধ থেকে রক্ষা করা। এটা একটা প্রাচীন অভ্যাস। নানা অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, অযৌক্তিক প্রত্যাশার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সেল্ফ-এস্টিমকে টিকিয়ে রাখা যথেষ্ট কঠিন। সবাই পারে না। সবার আগে তাকে এই অযৌক্তিক অবাস্তব প্রত্যাশা আর প্রতিযোগিতার থেকে রক্ষা করার জন্য তার মধ্যে একটা সতেজ স্বতঃস্ফূর্ত যুক্তিবোধ আর বাস্তববোধকে আনা জরুরি। সেও সময় থাকতে। নইলে ওই অপরাধবোধের ধিকিধিকি অনলে জ্বলে তার চিত্ত বিকারের আগার হয়ে ওঠে। তার রাগ, তার রূঢ় ব্যবহার সবই তার ইচ্ছাকৃত হয়ে ওঠে আমাদের ডিফল্ট মোডে থাকা দোষ অন্বেষার সামনে। আমরা নানা দোষে তাদের দোষীয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে প্রথালব্ধ কোনো একটা শাস্তিকে কায়েম করে ভারি একটা চরিত্র সংশোধনের ব্যবস্থা করলাম। এবং অবশ্যই এতে তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
কিন্তু সেই ঐতিহ্যময়, ঐতিহাসিক সুষমামণ্ডিত শাস্তি যখন ঘটনাকে আরো দুঃসহ করে তোলে তখন সেই দোষী, অপদার্থ, খুদে খুদে মনুষ্যরূপধারী শয়তানগুলোর অকৃতজ্ঞতার স্পর্ধা দেখে আমাদের বিস্ময়ের আর সীমাপরিসীমা থাকে না।
মনুষ্যচরিত্র জটিল। সে শিশুই হোক কি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। শিশু দেবতার রূপ। তার সরলতা স্বর্গীয় মাধুর্যময় - এ সব মিথ। কোনোটাই সত্য নয়। তাদের জটিলতাকে শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ অনুযায়ী না দেখলে শিব গড়তে বানর গড়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আর তার উদাহরণের অভাবও নেই চারপাশে।
লিও সেই জটিলতার মাঝে এসে দাঁড়ায়। একটা বাচ্চা তো শুধু বয়সে আর শিক্ষার তথ্যে বড় হয় না, বিকশিতও হয়। কিন্তু বিকশিত হওয়া আর বেড়ে ওঠার মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে অভিভাবক আর শিক্ষক উভয়েরই অনেক সময় মাথায় থাকে না। সেখানে আইনি ভাষায় “কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট” এসে “টাং এড়ায়”।
প্যারেন্টিংটা ঠিক ইনস্টিংক্ট না। ইনস্টিংক্ট দ্বারা পরিচালিত হলে আমরা এদ্দিন জঙ্গল ছেড়ে খুব বেশিদূর এগোতাম না। আমাদের নিজেদের শিক্ষিত করা দরকার। কোনোটাই গ্র্যান্টেড নয়।
দুদিন আগে এক বিয়েবাড়িতে আরাধ্যা আমাকে আলাদা ডেকে বলল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
আমরা বিয়েবাড়ির মধ্যেই অদৃশ্য ‘'ডোন্ট ডিস্টার্ব” টাঙিয়ে কথাবার্তা শুরু করলাম। তার স্কুলের নানা গল্প, তার শীতের প্ল্যানিং এবং আরো নানা সিক্রেট ইস্যু শুনতে শুনতে ভাবছিলাম ঈশ্বরের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ আমি, সে আমাকে এর যোগ্য মনে করেছে। এবং অবশ্যই তার বাবা - মাও আমার উপর সে ভরসা রেখেছে।
জটিলতা থাকবেই। আর তা দিন দিন বাড়বেই। তার বাস্তবোচিত সমাধানের রাস্তাও আমাদের বিবেক-বুদ্ধির নাগালের মধ্যেই। যদি না মোহান্ধ হই। নইলে দেখছি না? শিক্ষিত, অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক সুযোগসুবিধা আচ্ছাদিত তাবড়-তাবড় দুটো দেশ হাজার হাজার নিরীহ প্রাণ হত্যা করে এখন শান্তির কথা বলছে! এরা তো কেউ শিশু না। এই ম্যাচিওরিটি?
বয়েস না, বাস্তববোধ। মোহ না, সহমর্মিতা। এই দুটোই মানুষের প্রজ্ঞার প্রাণকেন্দ্র। লিও তার গল্পই বলে। পারল দেখতে পারেন। নেটফ্লিক্সে।