সৌরভ ভট্টাচার্য
12 March 2016
মেয়েটাকে আমি আজও চিনি। সাদা লালপেড়ে শাড়ি জড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে এ পাড়া ও পাড়া।
মেয়েটার কপালে বড় লালটিপ। সিঁদুর না, সিঁদুরের মত তবু। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। এককালে
যে ছিল সে চিহ্নটুকুও নেই।
ছোট্ট করে বলি। ছিল দাদা দিদির আদুরে ছোটোবোন। কেউ বলত দাম্ভিক, কেউ বলত প্রবল
আত্মবিশ্বাসী, কেউ বলত বড্ড নাক উঁচু, কেউ বলত টনটনে ওর আত্মসম্মানবোধ।
সুন্দরী তো ছিলই। ফর্সা গায়ের রঙ, চোখের উপর ঝাউপাতার মায়া, নাকের গড়ন পাথরে খোদাই
নর্তকীর মত। লম্বা ছিল - "এমন লম্বা মেয়ে, ছেলে জুটবে কপালে?" ঈর্ষা
চাপা সহানুভূতি গরম বাতাসের মত চলত আগুপিছু। ও পাত্তা দিত না।
তখন কলেজে পড়ে। অনার্সের বিষয়টা পড়াবে কে? চলল মেয়ে অমুক স্যারের বাড়ি। অমুক স্যার
অমুক স্যার, ভীষণ নাকি দেমাক! মেয়েমানুষ তার দু'চক্ষের বিষ। ক্ষমা ঘেন্না করে পড়ায়
নাকি কোনোমতে মেয়েদের, তবে ওই যে- পড়ায় নাকি এমন, মা সরস্বতীও সুযোগ পেলে পাতেন
নাকি আসন।
মেয়েটা যেদিন প্রথম এলো - পুড়ল সেদিনই অর্ধেকখানা বুক। বাকি বুকটা বাঁচিয়ে রাখল -
আহা রে, পুড়তে এমন সুখ!
ওদিকে যে চীনের পাঁচিল - শুধু রসায়নের কথা, ছিটকে ছিটকে যা আসে সে মুখের
এঁটোকাঁটা। মেয়েটা এগোলো বিস্তর পথ, পড়ায় বহুত জোর, ছেলেগুলো হাবুডুবু খায়, সে
এগোয় তরতর।
সেবার শীতে পিকনিক হবে। যাওয়া হল নদীর ধার। খুব হুল্লোড়, খুব হইচই। তবু মেয়েটার
মনে কিসের বাঁধ। বন্ধু বলল, সর্বনাশী, ও যে পাষাণের পাষাণে গড়া। ওই পাথরে তোর
প্রণয় কুসুম!!? - হায় রে কপালপোড়া!
তখন সন্ধ্যে। অনেকটা হেঁটে মেয়েটা বসেছিল ঘাসে, আঁচলখানা মেলে। হঠাৎ পাশে
সিগারেটের গন্ধ - আরে চেনা চেনা যে রে! পাশে এসে বসল পাঁচিল, পাথর, পাষাণের পাষাণ।
তারপর? জানি না। এসো আমরা সরেই বসি। ওদিকে অনেক উতোর চাপান।
তৃতীয় বর্ষে সে মফঃস্বলে সে কি হইচই। পাষাণ নাকি বিয়ে করবে। কাকে করবে? সে নাকি
আস্ত একটা মেয়েই।
বিয়ে হল। খুব ধুমধাম। সংসার পাতা হল। কেউ করে না চাকরী। দুজনেই পড়ানোতে মন দিল।
বছরখানা ঘুরতে না ঘুরতে, মেয়েটার চোখে পড়ল কালি। শরীর হল ক্ষীণকায়, কিছু গোলমাল হল
নাকি? দাদা শুধায়, মায়ে শুধায়, শুধায় প্রতিবেশী, মেয়েটা বলে, কই কিছু না, এই তো
ভাল আছি।
দেড় বছর ঘুরতে না ঘুরতে, পড়ল বিনা মেঘে বাজ! কই সে ছেলে, কই সে পাষাণ, কই সে
পাঁচিল, কই সে অহংকারী?
খবর এলো মাস দুই পর। পশ্চিমে এক কলেজে চাকরী পেয়েছে সে, সাথে গেছে সেই মেয়েটা, যে
অনার্সে এবার প্রথমবর্ষের।
দাদা শুধাল, মা শুধাল, বান্ধবীরাও শুধায়, হ্যাঁ রে জানতিস আগে? কি রে বল জানতিস
আগে? বল, বল, বল না রে!!!!
মেয়ে মুখে রা কাটে না। কিছু না। শুধু পাঁচিলের মত বসে। তার চোখের সেই ঝাউপাতার দল,
উদাস হাওয়ায় দোলে।
আমি যখন সব জানলাম, তখন সে মেয়েটা চারের ঘর ছোঁবে। সবই অতীত। তবু
গল্পটা এখনো আছে বেঁচে। সে এখন পড়ায় না আর। পড়াতে তার ঘেন্না। শাড়ির ব্যবসা করে
ফেরে সে। সব দীর্ঘশ্বাস এখনো ঘোরে, একা একা তার চারপাশে। আর কি করে? দীক্ষা নিয়েছে।
সারাদিন করে নামগান। কোন প্রভুতে কি যে খোঁজে - কি সে চায়, মুক্তিধাম?
প্রচুর করে ধর্মসভা। প্রচুর করে দান। জীবনে সবই বেহিসাবি তার। খবর রাখে তাদের নাকি
দুটো ছেলেমেয়ে। মেয়েটা নাকি খুব সুন্দর। ওরা এখন নাকি এলাহাবাদেতে।
কে বলেছিল - কুম্ভে যাবেন? তার মন উঠেছিল দুলে। যাবে যাবে যাবে। গিয়েছিল তো। জল
ছাপিয়ে, রাত ছাপিয়ে ঘুরেওছিল সেই সে পাড়া। যদি। একবার পড়ে চোখে।
পরে শুনেছিল তার পোড়া কপাল। তারা সবাই নাকি সে সময় কাশ্মীর গিয়েছিল। হা বিধাতা।
কুম্ভ কেন? কেউ না বলল, কাশ্মীর চল, বৈষ্ণোদেবী পুণ্যদর্শন হতই না হয় যেন।
একে কি ভাগ্য বলে? সেদিন সে দাঁড়িয়ে স্টেশানে। কলকাতা যাবে। শাড়ির অনেক অর্ডার
আছে। "কেমন আছো?" পিছন থেকে কে যেন ডাকল? তার সারাটা শরীর হিমশীতল হল।
বুকের কাছে হৃৎপিণ্ডটা বিরাম যেন দিল।
ফিরে তাকাল। ঘরে ডেকে নিল। এ কি চেহারা তোমার? শুকিয়ে কাঠ। বলল, সুগার ধরেছে, আরো
নাকি কি সব রোগ!
লোকটা কিসব বলেই চলে। মেয়েটার মাথাজোড়া শুধু ভোঁ ভোঁ। কে সে সামনে? সে তো নয়, এ তো
নির্জীব, নিষ্প্রাণ এক শবদেহ। এরই জন্য এতগুলো বছর??? হা ঈশ্বর? এরই জন্য? এতটা
দুর্বল, এত কাপুরুষ ছিল সে? এ যে তোমার চেয়েও অসহায় প্রভু। তবু তোমায় গড়ে নেওয়া
যায় - আর এ যে পূর্ণ কলঙ্কে ছেয়ে।
ফিরে গেল সে।
মেয়েটার কি হল? এতবড় এক লড়াই যেন সবটা ব্যর্থ হল। হারাবে যাকে, মনে ছিল পণ, সে
আগেই আছে হেরে, সব জেনে শুনে গভীর করূণায় বুক এল তার ছেয়ে।
প্রেমে যে জোর করূণায় তা নিমেষে হারিয়ে গেল। সব রক্ত তার মাথার শিরায় ঘনিয়ে সে বাহ
ছিঁড়ল।
মৃত্যু চুমে গেছে তার কপালের খানিক স্পর্শ নিয়ে, ভাগ্যরেখা ফিরিয়ে এনেছে, কিছুটা
সময় চেয়ে।
এখন কি করে? জানি না, জানি না। চিনতে পারে না কাউকে। অপেক্ষা নেই, অধৈর্য্যও নেই -
আছে আছে, তবু বেঁচে সে।