সাপখোপ তো দূরের কথা, আস্ত একটা জলহস্তী বেরিয়ে এলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই এত পুরোনো বাড়ি। বাড়ি ওই নামমাত্র। দশদিক ভাঙা। ছাদের সিংহভাগ ভাঙা। এত জঙ্গল, এত জঙ্গল চারদিক যে বলার নয়। এর মধ্যে ভর দুপুরে গিয়ে রতন পাগল ঢুকল, ঘুমাবে বলে। ভরপেট খাওয়া জুটেছে আজ। ঘুম তো আসবেই।
রতন ঢুকেই একটা ছাওয়া জায়গা দেখে শুলো। মাথাটা রাখবে কোথায়? একটা আধলা ইট তুলে আনতে যাবে, দেখে তার পাশে একটা ঠাকুরের পট। পোকায় খাওয়া। রতন ভালো করে দেখল, লক্ষ্মীর পট। দেখেই হো হো করে হেসে উঠল। বলল, এই অবস্থা করে রেখেছ মা গো? এই বলে সে সেই আধলা ইটের উপর পটটা রেখে প্রণাম করল। চোখ জুড়িয়ে এলো। ঘুমে ঢলে পড়ল মাথা।
====== ======
ছনছন আওয়াজে ঘুম ভাঙল রতনের। রোদটা ঢলেছে পশ্চিমে। কিন্তু আওয়াজটা? ওমা, ওকি?
ভাঙা জানলার উপর বসে, পা দুটো ঝোপের মধ্যে ঢুকে….লক্ষ্মী ঠাকুর না? হ্যাঁ, ওই তো প্যাঁচাটা ভাঙা লোহার রেলিঙটার উপর বসে। কিন্তু উনি এখানে কেন?
লক্ষ্মী আড়চোখে ভাঙা ইটের উপর রাখা পটটা দেখিয়ে বললেন, এই জন্যে।
রতন ভালো করে বসে, হাঁটুদুটো একজায়গায় জড়ো করে, হাতটা বেড় করে বলল, তা মা, নারায়ণ আসেননি?.... লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ… বামে না ডানে যেন? ঠাকুমা পড়তেন….তোমাকে তো পুরো পটের ছবিটার মতই দেখতে মা….কিন্তু আমি কী করব এখন? আমার তো পাঁচালি মুখস্থ নেই। এখানে কার্তিকের দোকানে গুজিয়া নকুলদানা পাওয়া যায়.. কিন্তু টাকা তো নেই….আর ভিখারিকে কে ধারে দেয় বলো…..
লক্ষ্মীদেবী বললেন, ব্যস্ত হোস না। আমি ফ্রি আছি খানিক বলে এদিকে এলাম। এরা এককালে ভীষণ বড়লোক ছিল….এই তুই যাদের বাড়ি শুয়ে…..কিন্তু সময় তো কাউকেই ছাড়ে না বল….তোকেই দেখ না…তোর বাবা মরে গেল….তুই পাগল….তোকে রেখে তোর মা চলে গেল….তুই হলি ভিখারি…..অথচ এই তুই গেল জন্মে কত বিদ্বান, ধনী ছিলি।
রতন বিস্মিত হয়ে বলল, তাই?! দুবেলা কী কী খেতাম মা?
বাব্বা! সেকি বলে শেষ করা যায় রে? তোর দাসদাসীরাই যা খেত বলে শেষ করা যায় না। অথচ এ জন্মে দেখ……
রতন বলল, দেখছিই তো…..কিন্তু কেন বলো তো মা?
লক্ষ্মীদেবী বললেন, সে সব কথা রাখ… কী বর চাস বল….
রতন ভাবল খানিক। তারপর বলল, কিছু না। তুমি খানিক গল্প করো। বর পেয়ে কী হবে বলো? খাওয়াপরা নিয়ে ভাবার অভ্যাস চলে গেছে। অসুখবিসুখ নিয়েও ভাবি না আর। দিন যাচ্ছে। আমাকে নিয়েই যাচ্ছে। আমি তো আর দাঁড়িয়ে নেই, না দিন দাঁড়িয়ে…কোথাও না কোথাও তো একটা ঠেকবই…তার চাইতে তুমি বলো….তোমার তো জন্মমৃত্যু নেই….বাড়াকমা নেই….অভাব-অভিযোগ নেই…..কিছু হারানোর নেই…কিছু পাওয়ার নেই…..কেমন লাগে তোমার?
লক্ষ্মীদেবী বললেন, তুই বড় ভাবিস….চল অন্ধকার হয়েছে গঙ্গার ধারে যাই…চল।
=======
এদিকে ঝোপঝাড়। আরেকটু বাঁদিকে হাঁটলে শ্মশান। এদিকে সাধারণত কেউ আসে না। লক্ষ্মী ঠাকুর আর রতন গঙ্গার পাড়ে বসল। জলে পা ডুবিয়ে।
রতন বলল, তোমার কী খেতে ভালো লাগে?
লক্ষ্মী ঠাকুর বলল, কেউ ভক্তি করে যা-ই দেয়….তা-ই।
রতন বলল, আমাকেও দেয়, তবেই খাই….তবে কী জানো….ওই ভক্তিতে কেউ দেয় না। হেলায় দেয়।
লক্ষ্মী ঠাকুর বলল, অহংকারে…
রতন হেসে বলল, এ কী বললে, অহংকার না থাকলে সব যে ঠাকুরদেবতা হয়ে যেত গো….থাক থাক….মানুষের সঙ্গে কথা বলে, মানুষের তাড়া খেয়ে যে সুখ….সে কি ঠাকুরদেবতায় আছে বলো?... তুমি যা-ই বলো…..সুখ তো আছেই…. গেলবার বর্ষায় রাস্তায় হেগেমুতে পড়েছিলাম….সাড় ছিল না…. একবার ক্ষীণ সাড় এলো….ভাবলাম মরে গেছি…..তারপর দেখলাম, না….হাসপাতালে…. কারা যেন এনে ভর্তি করে দিয়েছে…..আমি এত দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম, মা তোমায় কী বলি….মনে হচ্ছিল বুঝি মরলাম….তাও আমি তোমাদের কাউকে ডাকিনি…কেন বলো তো? এত এত মানুষ চারদিকে…. এরাই তো আছে….এই তো আমার সব…মারুক, কাছে ডাকুক…এদের ছেড়ে কোথায় যাওয়ার আছে?
লক্ষ্মী ঠাকুর বললেন, খিদে পাচ্ছে….এই নে পঞ্চাশ টাকা…..দুটো চপ আর মুড়ি কিনে নিয়ে আয় না…..
======
রতন দুই ঠোঙা চপ আর মুড়ি হাসতে হাসতে নিয়ে এলো। বসতে বসতে বলল, মা গো….আমায় বলেকি…এত কড়কড়ে নোট পেলি কই পাগলা? পকেট মেরেছিস…নাকি মন্দির থেকে হাতিয়েছিস? কী করে জানল ওরা এটা তোমার টাকা? মানেই তো মন্দিরের টাকা…..
লক্ষ্মী ঠাকুর চপমুড়ি খেল চুপচাপ। তারপর বলল, এই ঠোঙাটা রাখ রতন….যা খেতে চাইবি এর ভিতর থেকে পাবি….নে…..
রতন ঠোঙাটা হাতে নিয়ে বিহ্বল হয়ে বসে রইল। মা নেমে গঙ্গায় মিশে গেলেন। হাসলেন তার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এই ঠোঙা নিয়ে কী করবে সে?
রতন হাঁটতে হাঁটতে এলো রেললাইনের ধারে। তারপর রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করল। বেশ কিছুটা এগিয়ে একটা ঝুপড়ির কাছে দাঁড়ালো। ভিতরটা অন্ধকার। রতন বলল, ঠাকুমা আছ, না মরেছ?
ভিতর থেকে ক্ষীণ গলায় উত্তর এলো, আয় আয়….আছি এখনও।
রতন ঝুপড়ির মধ্যে মাথা নীচু করে ঢুকল। একি শরীরের অবস্থা ঠাকুমা তোমার? এতো বিছানায় মিশে গেছ?
বুড়ি বলল, কদ্দিন খাইনি রে পেট ভরে রতন…কিছু আছে তোর কাছে?.....
রতন বলল, কী খাবে?
বুড়ি বলল, বিষ।