পটলা আর পটলার মা'কে চেনে না বীরভূমে এমন কেউ নেই প্রায়। আবার পটলার বাবাকে গ্রামের কুকুররাই ঠিক মনে রাখতে পারে না, এমনই কম বেরোন উনি।
কিন্তু পটলার বাবাকে নিয়ে এ গল্প না। পটলার মা আর পটলার পরোপকারী কাজের গল্প লোকের মুখে মুখে ফেরে। গরীব ছাত্রছাত্রীদের বই কিনে দেওয়া, হাস্পাতালে অসহায় মানুষকে ভর্তি করা, মেয়ের বিয়ে আটকে গেলে তাকে সুপাত্রস্থ করা…. ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সব বলতে গেলে লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু আজকের গল্পের উদ্দেশ্য সে সব লেখা না। আসল গল্পে আসি।
সমস্যা শুরু হল যখন পটলা আর ওর মা যখন বারোটা ভ্যান ভর্তি কার্তিক ঠাকুর নিয়ে দমদম এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালো। এয়ারপোর্টে এসেই পটলা একজনকে জিজ্ঞাসা করল, স্যার… জাপান যাবার প্লেন কী ছেড়ে গেছে?
সে ব্যক্তি পটলাকে আর তার মা-কে আপাদমস্তক দেখে কোনো উত্তর না করে চলে গেল। পটলা আক্ষেপ করে বলল, মা এই জন্যে বলেছিলাম আমাকে ইংরেজিটা পড়াও। এখানে দেখছ, কেউ বাংলা বোঝে না। কী মুশকিল হল বলো তো!
পটলার অসহায় অবস্থা দেখে মায়ের খারাপ লাগল। আসলে ইংরেজী শিখে ছেলে বাইরে চলে যাক তার মা কোনোদিন চায়নি। এত জমিজায়গা, কে চাষ করবে? খাওয়া-পরা নিয়ে তো আর ভাবতে হবে না!
তবে আজকের ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে সেটাই বলি আগে। জাপান আর চীনে নাকি বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ ওদেশে নাকি বাচ্চাই হচ্ছে না আর আগের মত। এ খবরটা পড়া ইস্তক পটলার মা সুফলাদেবীর মনটা কেঁদে উঠেছে। আহা গো! এ কেমন কথা, গ্রামেগঞ্জে কোনো বাচ্চা নেই! কী আশ্চর্য! তারপর অনেক খোঁজ নিয়ে জেনেছে ও দেশে কেউ কার্তিক পুজো করে না। তা বাপু কার্তিক পুজো না করলে মা ষষ্ঠীর কৃপা হবে? ও দেশে কেউ কার্তিক ঠাকুর ফেলে না? কী পোড়ার দেশ গা!
তো সুফলাদেবী তো ভীষণ মনমরা হয়ে থাকেন। এদিকে পটলা মাকে নিয়ে ভেবেচিন্তে থই পায় না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করা আর না করা সমান। তিনি তো রাতদিন ঘরে শাস্ত্রতেই মুখ গুঁজে থাকেন। তাও পটলা একদিন বাবার ঘরে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, মায়ের অবস্থা তো চোখে দেখা যায় না…..
পটলার বাবা কালীপদ হেসে বলল, কোন অবস্থার কথা বলছিস বাবা…. মানুষ জাগ্রত, সুষুপ্তি, অর্ধবাহ্য, আর তুরীয়, এতগুলো অবস্থা আছে। তুই কোন অবস্থার কথা বলছিস বাবা?
ছেলে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, চীনে জাপানে মানুষের বাচ্চা হচ্ছে না…. প্রতিবেশী আমাদের… আমাদের তো কিছু ভাবা উচিৎ….. মা সেই ভেবে…..
পটলা হুহু করে কেঁদে উঠল।
যেই পটলা কেঁদে উঠল অমনি ওর বাবা চটে গিয়ে বলল, এই সব মায়ার মধ্যে আমাকে টেনো না বাবু… যাও…. বাইরে গিয়ে কাঁদো…. এ ঘরে মায়ার প্রবেশ আমি আটকিয়েছি…. জগতে তো পারব না…..যাও যাও….বাইরে যাও…
পটলা বাইরে চলে এলো। বাবাকে গালাগাল না দিয়ে কী করে গালাগাল দেওয়া যায় অভ্যাস হয়ে গেছে এদ্দিনে। সেটা দিতে দিতে বেরিয়ে এলো।
=======
কিন্তু এয়ারপোর্টে এদিকে তুমুল অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। সুফলাদেবী প্রচণ্ড রেগেমেগে হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছেন। এয়ারপোর্টের কর্তাব্যক্তিরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন বোঝাতে যে এভাবে বাইরের দেশে যাওয়া যায় না। তার জন্য ভিসা-পাসপোর্ট লাগে। আর এসব মূর্তি নিয়ে তো যাওয়াই যায় না।
পটলার মা মেঝেতে দু'পা ছড়িয়ে বসে, গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছে, তোদের কী পাষাণ মন রে…. বলি নিজেদের ঘরে তো ছেলেমেয়ে আছে নাকি…. ওদের দেশের মানুষ কি আমাদের থেকে আলাদা নাকি রে…. একটু একটা টিকিট কেটে দে… না হয় আমি গেলাম না…. পটলা আমার লক্ষ্মী ছেলে… চুপ করে গিয়ে কার্তিক ঠাকুর ফেলে আপ প্লেনে গিয়ে…. ডাউন প্লেনে ফিরে চলে আসবে….. ব্যস। এর জন্যে এত? তোদের দেশেই তো কত মহাপুরুষ জন্মেছিল রে…মানুষের সেবার কথা বলেছিল…. বিবেকানন্দ কেমন বিদেশে দুর্গাপুজো প্রচার করতে গিয়েছিলেন… আজ দেখ কত দুর্গা ঠাকুর বিদেশে যায়…. তবে না ওদের এত মঙ্গল…
ঘটনাটা কদ্দূর এগোতো বলতে পারি না। হঠাৎ কয়েকজন মহিলা ভিড় করে বসল সুফলাদেবীর সামনে। তারপরে আচমকা চীৎকার করে গান ধরল। কী ভাষা এটা? শুধু মাঝে মাঝে "মুরুগান মুরুগান" বলে একটা কথা শোনা যাচ্ছে। মুরুগান কে? আবার থেকে থেকে কেউ কেউ "কার্তিকেয় কার্তিকেয়" বলছে….. মানে কী হচ্ছে গা এটা?
পটলার মা বিস্ফারিত চোখে এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ তার মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ মালা কোত্থেকে জোগাড় করে গলায় দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার টাকা রাখছে পায়ের কাছে।
বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব থাকার পর পটলা আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন পুরুষকে জিজ্ঞাসা করল, দাদা কী হচ্ছে এটা?
একজন ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, তোমার মা পরমেশ্বরীর অংশ…. কার্তিকেয়র মা….. মানে মুরুগানের মা…..নইলে কার্তিকের জন্য এত কাঁদে?
তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে পটলাকে বলল, বাবা, আমাদের প্লেনের সময় হয়ে যাচ্ছে, তোমার মাকে বলো আমাদের সঙ্গে যেতে…. আমাদের মধ্যে কজন থেকে যাবে….আমরা তোমাদের ট্রেনে করে নিয়ে যাব… এইসব মূর্তিও নিয়ে যাব। আমাদের ওখানে কার্তিকের অনেক বড় উৎসব হয়। যাবে?
পটলা কী বলবে বুঝতে না পেরে তার মাকে সব বলল। তার মা সব শুনে বলল, ওদের দেশ থেকে চীন জাপান কতদূর জিজ্ঞাসা কর….
পটলা জিজ্ঞাসা করল।
সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। একজন বলল, আমি অনলাইনে সেখানে কার্তিকের পুজোর ব্যবস্থা করে দেব…. তোমরা চলো….. আমাদের এই দু'জন থাকল…তোমাদের ট্রেনে নিয়ে আসবে… আর সব মূর্তি ট্রাক ভাড়া করে চলে আসবে…. আসবে?
পটলার মা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, তোর বাবাকে ফোন কর পটলা।
কালীপদ ফোন ধরে সব শুনল। ধীরে ধীরে মাথাটা গরম হল। গরম মাথায় ব্রহ্ম থাকে না। আর ব্রহ্ম না থাকলে ইহকাল পরকালই বা কী….. স্নানখাওয়া…. এসবের কী হবে? বলি আত্মার আত্মজ্ঞান হবে বলে তো আর শরীরকে বঞ্চিত রাখা যায় না…. তিনি রেগেমেগে বললেন, তুমি আর তোমার মা…. মানে ওই বাউণ্ডুলে মাগীকে বলো আজ রাতের মধ্যে না এলে তোদের খুন করে ফেলব আমি……
পটলা ফোন কেটে দিল। ফোন সুইচ অফ্ করে দিয়ে মা-কে বলল, বাবা বলল অবশ্যই যাও……