তার কাজ হল জুতো দেখে রাখা। মাসে কত টাকা হয় বলতে পারি না। তবে চলে যায়। লোকে মন্দিরে ঢোকার আগে জুতো রাখার একটা ভরসার জায়গা তো খুঁজবেই। ভরসা করা আজকালের দিনে চাট্টিখানি কথা নাকি? ভগবানেও ভরসা নেই বলেই তো ওই দেখো না ক্যামেরা লাগানো আছে। কে ঢুকছে কে বেরোচ্ছে সব রেকর্ড করে রাখছে চিত্রগুপ্তের খাতায়।
তো তাকে সবাই মাসি বলে ডাকে। জুতো মাসি। সে কিছু মনে করে কিনা বলতে পারি না। কিন্তু সাড়া দেয়।
একদিন একটা বড় গাড়ি করে লোকেরা এলো মন্দিরে। তারা জুতো গাড়িতেই রেখে এসেছে। জুতো মাসির কাছে কেন আসবে? ও বাবা! এলো। সঙ্গে একটা কুকুর নিয়ে এলো। সে বাঘের মত ইয়াব্বড় কুকুর! সাদা সাদা লোম যেন দুধ দিয়ে স্নান করায় রোজ। কুকুরটার মুখটা দেখে জুতো মাসির কেমন জানি মনে হল ওর মনে সুখ নেইকো। তো তারা এসে জুতো মাসিকে বলল, ওহে, এই কুকুরটা এখানে বেঁধে থুয়ে গেলাম। এই বিস্কুটের প্যাকেট। এই দুধের প্যাকেট। এই বাটি। এই ডিস। তুমি ওকে এই আধঘন্টা বাদে এগুলো খাইয়ে দিতে পারবে? যদি পারো তবে তোমায় পাঁচশো টাকা দেব।
এই বলে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা, বেশ বুড়ো একটা লোক, মোবাইলটা বার করে বলল, এই এখন চারটে পঞ্চাশ। তুমি ওকে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ দিলেও হবে। আচ্ছা?
জুতো মাসি এমনি পশুপাখি ভালোই বাসে। সে বলল, আচ্ছা!
=======
দাঁড়াও গল্পটা একটু দাঁড় করিয়ে নিই। এই যে 'জুতো মাসি', 'জুতো মাসি' বলছি, এতে অনেকে আপত্তি করতে পারে। আজকাল সবটাতে আপত্তি করা লোকেদের একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তো এই জুতো মাসির একটা নাম ছিল এককালে, সুন্দর নাম, ফুলের নাম, শিউলি, সেটাই বলি তবে? আসলে মাসির নিজেরও নামটা শুনলে সঙ্কোচ হয়, জুতোর গন্ধে দিন কাটাতে কাটাতে হঠাৎ শিউলি বললেই, তার গন্ধটা মাথায় আসে না। এখন বলো, শিউলির গন্ধের সঙ্গে জুতোর গন্ধ যায়? যায় না তো। আমিও তো তাই বলছি।
তো শিউলিমাসির সামনে তো কুকুরটা বেঁধে রেখে চলে গেল। অবশ্য খুব সামনে না। অনেক সামনে রাখলে তো আর অন্য লোকেরা জুতো রাখতেই আসবে না। তাই না?
কিন্তু মাসি কুকুরটার দিকে তাকায় আর মনটা খারাপ হয়ে যায়। এর চাইতে তার নেড়িটা কি হাসিখুশি থাকে। ম্যাটাডোরে তার পিছনের ডান পা-টা ভেঙে দিয়েছে, তাও সে আনন্দে থাকে। আর একে দেখো! শিউলিমাসি এইসব ভাবছে। তার নেড়িটার একটা নামও আছে, ছুপছুপ। সে যখন ছোটো ছিল, তার মা তো তাদের জন্ম দিয়েই পাশের এই হাইরোডে লরি চাপা পড়ে মরল। ওর বাকি ভাইবোনগুলোও মরল রোগে ভুগে। এটা কি করে জানি বেঁচে গেল। তা সংসারে কে বাঁচবে আর কে মরবে এত সহজে বলা যায়? কি বলো? তো বাঁচল। রাতদিন এদিক ওদিক ছুঁকছুঁক করে বেড়াতো। সেই থেকে ওর নাম ছুপছুপ হয়ে গেল।
=======
শিউলিমাসি কুকুরটাকে দুধ আর বিস্কুট খেতে দিল। সে সামনের পা দুটো একটা একটার উপর তুলে, তার উপর মাথা রেখে শুয়েই থাকল। শিউলিকে দেখে ডাকা তো দূর, তাকালোও না।
কিন্তু গোলমাল হল ছুপছুপ আসার পর। সে পেটুক কুকুর। তায় পেট ভরেনি ঠিক করে আধখানা জীবন প্রায়, সে কেন অমন সাদা দুধের বাটি আর অতগুলো বিস্কুট দেখে শান্ত থাকবে! সে প্রথমেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। শিউলিমাসি অনেক থামাতে চেষ্টা করল। থামল না। পাশের দোকান থেকে ওর খাওয়ার সস্তা বিস্কুট কিনে দিল, তাও থামল না। ওগুলো রাস্তাতেই পড়ে থাকল, মুখেও দিল না।
খানিকবাদে নিজেই থামল। কুঁইকুঁই করতে করতে চেন বাঁধা বড়লোকি কুকুরটার কাছে গেল। সে নির্বিকার। ছুপছুপ যে এত চেঁচামেচি করল তাকে দেখে, তাতে তার কোনো বিকার ঘটল? রাগারাগি কি ঘড়ঘড়…. কিচ্ছু না। চুপ করে শুয়ে শুয়ে ছুপছুপের কাণ্ড দেখছিল। শিউলির তেড়ে তেড়ে গিয়ে তাকে আটকানো দেখছিল। কিন্তু তার কোনো বিকার নেই।
কিন্তু এইবারে যা ঘটল সে বাপের জন্মে শিউলি দেখেনি। ছুপছুপ গিয়ে ওর বাটির থেকে সবটা দুধ তো খেলোই, উপরন্তু সব কটা বিস্কুটও সাবাড় করে দিল। শিউলির তো রাগে, অপমানে, লজ্জায় কি যে হচ্ছিল। একবার মনে হল বাড়ি চলে যায়, ওদের কুকুর ওরাই বুঝুক। আবার মনে হল এই এতগুলো জুতো অন্যদের। এরা তো নয় আজই চলে যাবে খানিক পরেই, তাকে তো এখানেই থাকতে হবে, এইসব রেগুলার খদ্দেরদের নিয়ে। তার ছেড়ে যাওয়া যাবে না।
=======
তারা সব পুজো দিয়ে এলো ছটা নাগাদ। ও, ওরা কারা কারা ছিল তো আগে বলিইনি। ওই বয়স্ক ভদ্রলোকের বউ, আর তাদের দুই ছেলে-মেয়ে এসেছিল। তারা সব গাড়িতে গিয়ে উঠল। বয়স্ক মানুষটা শিউলির কাছে এসে বলল, বাহ্! সবটা খেয়েছে দেখছি। আপনাকে আমি এক হাজার টাকা দেব। ও বাড়িতে আজকাল খাওয়া দাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে বুঝলেন। ওর জন্যেই আসলে পুজো দিতে আসা। এই নিন টাকাটা…..
শিউলির কান গরম হয়ে গেল। বলল, আপনার কুকুর ওসব খায়নি, খেয়েছে আমার কুকুর…. আমি ঠেকাতে পারিনি…. আপনি চান তো আমি দুধের আর বিস্কুটের দাম দিয়ে দিতে পারি… জানি ওসব আপনাদের লাগবে না…. তবু….
বয়স্ক মানুষটা মোবাইল বার করে সময় দেখল। বলল, আমার হাতে এখনও ঘন্টাখানেক আছে। কই তোমার কুকুর? দেখি নিয়ে এসো তো।
শিউলি শিউরে উঠে বলল, মারবেন?
বয়স্ক মানুষটা বলল, সে দেখা যাবেখন। পুলিশেও দিতে পারি। আপনাকেও। আপনারা আমার জ্যাকির খাবার চুরি করেছেন। আপনারা মানে আপনার কুকুর!
শিউলি বলল, চুরি!? আপনার কুকুর ও খাবার ছুঁয়েও দেখছিল না। ও খাবার নষ্টই হত। বরং বলুন আমার ছুপছুপ আপনার খাবার উদ্ধার করেছে।
এমন সময় ছুপছুপ কোথা থেকে এসে হাজির হল। কি বলব আপনাদের, শিউলির মুখটা দেখার মত হল। যেন দিনের বেলায় ভূত দেখেছে। সে ইশারা করে যত ছুপছুপকে চলে যেতে বলে, ছুপছুপ তত কুঁইকুঁই করে সেই বয়স্ক মানুষের দামী জুতোর কাছে চলে আসে। লেজটা প্রবল বেগে নাড়াতে নাড়াতে, সেই মানুষটার পায়ের কাছে শুয়েপড়ে এমন সব অঙ্গভঙ্গি শুরু করে দিল, শিউলি তো হাঁ!
ওদিকে সেই বড় মানুষটা ছুপছুপের কাণ্ড কারখানা দেখে তো হেসেই বাঁচে না। সে হাসতে হাসতে বলল, এই আপনার কুকুর! বাহ বাহ! বেশ বেশ। বড় মিঠে স্বভাব।
এই বলে যেই না ঝুঁকে পড়ে আদর করতে গেছে ছুপছুপকে, অমনি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো সেই দশাশই দামী কুকুরটা। ছুপছুপ তাকে দেখে আরো কাছে চলে এলো বড়লোক মানুষের জুতোর কাছে। অমনি বাঘা কুকুরটা, বলব কি মশায়, এক লাফে সে বুড়ো মানুষটার কোলে উঠে পড়ল। আর অমনি কিনা বুড়ো মানুষটা বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে কাঁদতে বলল, আহা রে, সোনারে, কদ্দিন বাদে তুই আমার কোলে এলি…. ওগো দেখে যাও… আজ আমার কি সুখের দিন….
অমনি গাড়ি থেকে তার ছেলে-মেয়ে-বউ পড়িমরি করে ছুটে এসে, চোখমুখ খামচিয়ে জল বার করে সেল্ফি তুলতে শুরু করল।
তখন বড় মানুষটা সেই ধুমসো কুকুরটাকে কোলে নিয়ে ছুপছুপের পা, লেজ মাড়িয়ে গটগট করে হেঁটে গাড়িতে উঠে গেল। আর ছুপছুপ কেঁউ কেঁউ করে রাস্তায় শুয়ে লুটোপুটি খেতে লাগল।
শিউলি তো সব দেখে হতভম্ব। ওদিকে ওদের গাড়িতে ওরা সব উঠে গেছে। বুড়ো মানুষটা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, চারটে পাঁচশো টাকার নোট রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলল, নে…. তোরা খুশী থাক রে….
শিউলি একবার ছুপছুপকে দেখছে, একবার টাকাগুলোকে…