ভদ্রমহিলার বয়েস পঞ্চাশের আশেপাশে হবে। আমি যেখানে বসে আছি তার থেকে একটু দূরে বসে। বেলুড় মঠে বিকেল। শ্রাবণ মাস। প্যাচপেচে গরম। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি নেই কদিন হল।
ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে যেন জল ভর্তি টসটসে বেলুন। একটু আঘাত করলেই ফেটে পড়বে। এমন মুখ অনেকবার দেখেছি। বিশেষ করে মঠে, মন্দিরে তো বেশি করে। এখানে দুঃখ, ব্যথা অঞ্জলির মত সেজে ওঠে। ক্ষোভে তপ্ত না। হয় তো বা অভিমানে একটু বেশি নীরব।
একটু পরেই উঠে দাঁড়ালেন। একজন বয়স্ক সন্ন্যাসী এসেছেন। পরিচিত মনে হল। উনি পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। তারপর দুজনেই দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
সব কথা তো বলার না। কিন্তু কথা বলতে বলতে মহিলার গলা বুজে আসা, আঁচলে চোখ মোছা আমাকে আড়ষ্ট করে বসিয়ে রাখল। উঠে আসা যেত। আমি উঠলাম না।
সন্তান হারিয়েছেন। স্বামী হারিয়েছেন। এতটা বুঝলাম। সঙ্গে নানা সাংসারিক অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে আত্মীয়স্বজনের তাড়না।
সন্ন্যাসী চুপ করে শুনছেন গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। কান্নার উত্তর তো শব্দ হয় না। নীরবতা হয়। নয় কান্না হয়। সব কান্নার তো অশ্রু হয় না।
সন্ধ্যে হব হব। একটু পর আরাত্রিক শুরু হবে ঠাকুরের মন্দিরে। পাখিগুলো গাছে ফিরছে। তাদের ঘরে ফেরার উল্লাসের আওয়াজ গাছে গাছে। ওপারে বিদ্যুৎ চমকে উঠল কয়েকবার। হাওয়া উঠল।
সন্ন্যাসী বলছেন, দেখো মা, এই যে সামনে গঙ্গা বইছে, তুমি আমি চাইলেই তো এইখানে নামতে পারব না। ওই যে গঙ্গার ঘাট, মায়ের মন্দিরের সামনে, সেই দিয়েই নামলে সুবিধা। আমাদের কাছে ঠাকুর, মা হচ্ছেন এই বাঁধানো গঙ্গার ঘাট। ঠাকুরের সামনে, মায়ের সামনে বসো। সুখ, দুঃখ, সমাধান কিচ্ছু চেয়ো না। শান্তি চাও। শান্তি। শান্তি পেলে সব পাবে। ঠাকুর, মাকে ডেকে শান্তি পায়নি, এমন হয় না। সুখ, দুঃখ এড়াতে কেউ কোনোদিন পারেনি। ঠাকুরকে ডাকতে ডাকতে মনে বল বাড়ে। সে বল বাড়ে বলেই মনে শান্তি আসে। এটা কোনো ম্যাজিক না। দুর্বল হোয়ো না।
ভদ্রমহিলা এ সব কথাগুলোই জানেন। এ কথাগুলো শোনা কথা। জানা কথা। পড়া কথা। কিন্তু এখন যেটা শোনা হল সেটা অনুভবের কথা। দরদের কথা। সান্ত্বনার কথা। তার তো বিচার হয় না। দরদী আশ্বাস।
কদিনের গুমোট গরমের পর ঠাণ্ডা হাওয়া দিল। এমন নয় যে এ হাওয়া আগে পাইনি। অপরিচিত। কিন্তু একদিনের হাঁসফাঁস অবস্থা এ হাওয়াকে সঞ্জীবনীর মত বোধ করালো।
আরতি শুরু হবে। ধীরে ধীরে এগোলাম। শ্রীরামকৃষ্ণ ঘাটের দিকে। যেদিনে শান্তি। যেদিকে আশা। যেদিকে আত্মবল।