Skip to main content

ঘটনাটা বলব ভাবিনি কোনোদিন। কিন্তু বলাটা দরকার। নইলে নিজের কাছে অপরাধী থেকে যেতে হবে। আর বিপুল, মানে আমার ছোটোবেলার বন্ধু, ও নিজে থেকেই বলল, বলে দিতে। কারণ ঘটনাটার সঙ্গে ও নিজেই জড়িয়ে। 

     আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আমি, বিপুল, রাশি আর অম্লান --- চারজন ভীষণ বন্ধু ছিলাম। এর মধ্যে আমি আর বিপুল ফিজিক্স অনার্স, অম্লানের কেমেস্ট্রি আর রাশির ম্যাথ। রাশি আর অম্লান ক্লাস ইলেভেন থেকেই কাপল। ওদের বাড়ির লোকেরাও জানত। 

     ঘটনাটায় আসি। রাশির জন্মদিন। রাশি সব সময়েই একটু অফবিট কিছু ভাবতে চায়। রাশির বড়মামার রাণাঘাটের ওদিকে মাটিকুমড়ো গ্রামে একটা বাগানবাড়ি আছে। রাশি ঠিক করল আমরা কলেজ শেষে বাইক নিয়ে ওদিকে বেরিয়ে যাব। ওখানে ডিনার করে রাতে ফিরব। রাশির মা বিরিয়ানি রেঁধে পাঠাবেন। আন্টির হাতের বিরিয়ানি মানে সত্যিই স্পেশাল কিছু একটা। 

     যেমন প্ল্যান তেমন হল। আমাদের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস শেষ হতে একটু দেরি হল বলে বেরোতে বেরোতে প্রায় ছ’টা হয়ে গেল। নভেম্বর মাস, চার তারিখ। ঠাণ্ডা খুব একটা পড়েনি। কিন্তু বেলা তো ছোটো। রাস্তাতেই ভালো অন্ধকার নেমে এলো। 

     দুটো বাইক, একটাতে আমি আর বিপুল, আরেকটাতে রাশি আর অম্লান। রাশিও ভালো বাইক চালাতে পারে। ও যখন অম্লানের বুলেটটা চালিয়ে যেত রীতিমতো হাঁ করে লোকে তাকিয়ে থাকত। এখন তো স্কুটি কনসেপ্ট এসেছে, তখন ওসব কিছু ছিল কই? একটা মেয়ে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে, তাও আবার বুলেট! 

     আমরা চাকদা ছাড়িয়ে গেলাম। মাঝখানে একটু দাঁড়িয়েছিলাম চায়ের জন্য। মাথাটা ধরেছে আমার। এ এক আমার পুরোনো রোগ। মাইগ্রেন। মাথার অর্ধেকটা টিসটিস করেই যাচ্ছে। বাড়াবাড়ি হলে বমি হয়ে তবে ছাড়বে। আজ তো চান্সই নেই ছাড়ার। 

     রাণাঘাট ছাড়িয়ে এলাম, কিন্তু ওদের কোনো ট্রেস নেই। বিপুল একবার বলল, দাঁড়াবি? আমার ইচ্ছা করল না। আমার ইচ্ছা পৌঁছে একটু রেস্ট নেওয়ার। বমি হবে মনে হচ্ছে। বিপুল ফোন করতেও চাইল, আমি বাধা দিলাম, কি দরকার, কে চালাচ্ছে তার ঠিক আছে? তাছাড়া রাস্তা দিয়ে যা বিচ্ছিরিভাবে গাড়িগুলো যায়। 

     আমরা মাটিকুমড়ো পৌঁছলাম সোয়া আটটা নাগাদ। আমার ঢুকেই বমি হল। কিন্তু কমল না। আমি সত্যদাকে, মানে যে বাড়িটার দেখাশোনা করে আর কি, তাকে বললাম, একটু চা খাওয়াও না…, বলেই ঘরে এসে আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। 

     কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না, হঠাৎ চীৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল। বাইরে এসে দেখি রাশি আর অম্লান, বিধ্বস্ত পুরো, বারান্দায় মেঝেতেই বসে… রাশি রীতিমতো কাতরাচ্ছে। বিপুল বরফ দিচ্ছে মনে হল। কাছে গিয়ে দেখি দু'জনেরই জামা-কাপড় ফালা ফালা হয়ে যা-তা অবস্থা। বাইকটার সামনেটা দুমড়ে গেছে। 

     রাশি বলল, সত্যদা তুমি কিছু একটু খাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও না গো… আমাদের সব রাস্তায় পড়ে…

     ঘটনাটা শুনলাম। ওরা আমাদের পিছনেই ছিল। অম্লানের মাঝরাস্তায় বড় বাইরে পায়। তো চাকদায় নেমে ওসব সেরে বেরোতে বেরোতে দেরি হয়ে যায়। আমরা টেনশান করব বলে আমাদের কিছু জানায়নি। রাণাঘাটের আগে, রাস্তাটা বেশ অন্ধকার, সামনে হঠাৎ কোত্থেকে একটা বাছুর চলে আসে, তাকে পাশ কাটাতে গিয়ে স্কিড করে পাশের জমিতে নেমে যায় গাড়ি। যা হোক, হেলমেট ছিল বলে মাথাটা বেঁচে যায়। 

     আমি একবার বললাম, চল রাণাঘাট হাস্পাতালে যাই, যদি কিছু সিরিয়াস হয়ে থাকে…

     রাশি বলল, না রে, এমনিতেই সবটা মাটি তো হলই… আমি আমার জন্মদিনের বাকিটা হাস্পাতালে সেলিব্রেট করতে পারব না... প্লিজ…

     আমি বললাম, তবে রাতটা থেকে যাই এখানে…

     অম্লান আমতা আমতা করতে লাগল…

     আসলে অম্লানের বাড়ি এইসব ব্যাপারে একটু কনজার্ভেটিভ… রাশি আছে জানে…

     অম্লান বলল, না রে পিসি এটাকে একটা ইস্যু করবে… ছাড়… রাত করেই না হয় ফিরব…

     আমি বললাম, বাইক?

     রাশি বলল, মামাকে ফোন করেছিলাম…মামার এক বন্ধু আছে এখানে… এই ক'টা বাড়ি পরেই… বাইক ওখান থেকে নিয়ে নেব…

======== =========

     খাওয়া শেষ হতে হতে দশটা হল। সত্যদা অমলেট আর ডালভাত খাওয়ালো। রাশি ভীষণ আপসেট। অম্লানও। রাশি বলল, এটা একটা সেলিব্রেশান হল বল?… যা হোক ডিউ থাকল…

     আমরা বেরোলাম যখন সাড়ে দশটা। ওরা বলল, তোরা এগো, আমরা আসছি…

     বিপুল আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। আমি এগোলাম… বললাম, রাণাঘাটে অপেক্ষা করছি, আয়। 

     বিপুল বলল, তুই একটা মাথামোটা… ওদের একটু প্রাইভেসি দিবি না… দেখছিলি না ওরা দু'জনেই বেরোবার আগে উসখুস করছিল। 

     আমি সত্যিই খেয়াল করিনি। আসলে করার মত অবস্থাতেই ছিলাম না। আবার বমি-বমি লাগতে শুরু করেছে। 

     প্রায় এগারোটা বেজে গেল। রাণাঘাটেই দাঁড়িয়ে। ওদের ফোনও সুইচ অফ্ আসছে। কি করব বুঝতে পারছি না। বিপুলকে বললাম, ওদের সঙ্গে ফোন ছিল? মানে রাস্তায় যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল সেখানে পড়ে যায়নি তো?… আমি কিন্তু ওদের হাতে ফোন মনে করতে পারছি না…

     যা হোক। আবার মাটিকুমড়ো ফিরলাম। কেউ নেই। বাড়ির রাস্তায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। চাকদা ছাড়িয়েছি, হঠাৎ দেখি একটা জায়গায় বেশ জটলা। পুলিশের গাড়ি। কাছে যেতেই দেখলাম, আরে এতো অম্লানের বাইক! আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আমাদের বাইকটা সাইড করে পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? 

     পুলিশ বলল, আরে একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্ট… একটা ছেলে আর মেয়ে ছিল…স্পট ডেড… বিচ্ছিরি রকমের কলিশন…

     বিপুল আমার দিকে তাকিয়ে। আমার গা হাত পা কাঁপছে। দাঁড়াতে পারছি না… বললাম, বডি…?

     একজন একদিকে দেখিয়ে বলল, ওই দিকে….

======== =========

     এর দশ বছর পরের ঘটনা, আমি আর বিপুল এই মাটিকুমড়োর বাগানবাড়িতে এসেছি। এটা এখন ভাড়া দেওয়া হয়। রাশির বড়মামার কাছ থেকে কেউ একজন লিজ নিয়েছে বিজনেসের জন্য। আমরা দু'জনেই নিজেদের জগতে ব্যস্ত এখন। দেখাসাক্ষাৎ কমই হয়। ওই ফোনেই যা। কিন্তু এই বাড়িটার উপর কেমন একটা টান আমাদের। শেষবার এখানেই তো চারজন একসঙ্গে হয়েছিলাম!

     রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা বাইরে বসে। সামনে ধানক্ষেত। আরেকটা পরিবার আছে দোতলায়। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। রাত একটা হবে। 

     আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। বলতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ দেখি বিপুলের মুখের ভাবটা কেমন ফ্যাকাসে। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইছে। আমি প্রথমে ভাবলাম শরীর খারাপ লাগছে হয় তো ওর… কিন্তু ওর আঙুলের ইঙ্গিতটা ধরে তাকিয়ে দেখি আমাদের সামনের দোলনাটা অল্প অল্প দুলছে…

     আমি বললাম, আরে কিছু নয়… কতদিন হয়ে গেল বল তো…

     বলতেই দোলনাটা একবার শূন্যের দিকে উঠে ধড়াস্ করে পড়ল…

=========== =======

     এরপর থেকে আমরা প্রতি বছর রাশির জন্মদিনে মাটিকুমড়ো যাই। আমি আর বিপুল। আমাদের আড্ডা হয়। অসুবিধা হয় না। দেখা না গেলেও আমরা যে চারজনই আছি, অনুভব করি। আজ বুঝি, মানুষ একটা অনুভব ছাড়া আর কিছু নয়।