Skip to main content

 

001.jpg

ইদানীং হিন্দু ঠিক করে উঠতে পারছে না খাঁটি হিন্দুর প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য কী কী হওয়া উচিৎ। স্বামী বিবেকানন্দ একটা ভিত গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। “হিন্দু ধর্মের সাধারণ ভিত্তি” নামক প্রবন্ধে সে আলোচনা বিস্তারিত আছে। এ ছাড়াও “ভারতে বিবেকানন্দ” নামক বইতে আরো আরো অনেক জায়গাতেই আছে।

কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দর দিন হয় তো গেছে। তাঁর বিশ্বাসের সঙ্গে এখন অনেকেই সহমত পোষণ করেন না আন্তরিকভাবে। যদিও বাইরে শ্রদ্ধার ভঙ্গিটা রাখেন। কিন্তু এখন অনেকেরই ধারণা হিন্দুধর্মকে রক্ষা করতে হলে স্বামীজীর দিশার চাইতে আরও উপযোগী দিশা তাদের জানা আছে।

ইদানীং হিন্দুধর্মের একজন উচ্চ পদাধিকারী আচার্য আরেকজন জনপ্রিয় সাধুর হিন্দুধর্মের জ্ঞান নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, “উনি আমার সামনে সংস্কৃততে কথা বলে দেখান তো”। অন্যদিকে আমিষ নিরামিষ নিয়েও খাঁটি হিন্দু হওয়ার একটা বিধান ইদানীং মাথা চাড়া দিচ্ছে।

আজকে পড়লাম সম্ভল নামে উত্তর প্রদেশের একটা জায়গায়, শিবমন্দির থেকে বহুদিনের পুজিত সাঁইবাবার মূর্তি তুলে ফেলে, গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে সেই জায়গায় গণেশের মূর্তি স্থাপন করে “খাঁটি সনাতন” ধর্মের শুদ্ধতা বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে গতকাল।

সাঁইবাবা হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। গীতা, বিষ্ণুসহস্রনাম, ভাগবত, রামায়ণ ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠ করার উপদেশ দিতেন। যে মসজিদে থাকতেন, তাকে মা বলতেন। সামনে তুলসীমঞ্চে জল দিতেন। সেখানে রামনবমী থেকে শুরু করে উরুস সব ধর্মের অনুষ্ঠানের আয়োজন হত। হিন্দুধর্মের পুজোপার্বণের দিনগুলোকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতেন। ওঁর জীবনী পড়লে দেখা যায় কত কত ধর্মপ্রাণ হিন্দু ওঁকে কী শ্রদ্ধার সঙ্গে মানতেন। ঈশ্বরের অবতার হিসাবে দেখতেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। শিক্ষিত, অশিক্ষিত কত শত মানুষ এসেছেন। শান্তি পেয়েছেন। দিশা পেয়েছেন। আজও শিরডিতে গেলে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল দেখা যায় তারা কারা? তারা এদেশেরই সরল ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী মানুষ। তাদের অনেকেরই সিংহাসনে প্রচলিত হিন্দুদেবদেবীর সঙ্গে সঙ্গে সাঁইবাবাও পুজিত হন। অনেকের বিশ্বাসে তিনি শিবের অবতার। অনেকের বিশ্বাসে তিনি দত্তাত্রেয়। ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর থেকে শুরু করে, ইদানীং পদ্মশ্রী প্রাপক শিবাবন্দ বাবাজীর মত বহু বিখ্যাত, প্রতিভাশালী ‘খাঁটি’ হিন্দুদের বাড়ি তিনি নিত্য আরাধ্য। শিবের অবতার।

হিন্দুধর্ম গ্রহণশীল, সংবেদনশীল, সহিষ্ণু - এ কথাটা অর্ধসত্য ন্যারেটিভ। গ্রহণশীলতা দিয়েই হিন্দুধর্মের ভিত তৈরি হয়েছে। আর্যরা এদেশে আসার আগে অনেক দেবদেবী জনজাতির মধ্যে ছিল। তাদের নিজেদের ভাষা, প্রথা, ধর্ম ছিল। মহাদেব থেকে শুরু করে অনেক দেবদেবীর প্রাচীনত্ব খুঁজতে গেলে সেই প্রাক-আর্য জনজাতির দরবারে হাজির হতে হয়। একে একে নানা দেবদেবী, নানা প্রথা, নানা বিশ্বাস ইত্যাদির জটিল বুননে সৃষ্টি হয়েছে এই আশ্চর্য, অনুপম হিন্দুধর্মের ভিত।

অন্যান্য ধর্ম যেমন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মতত্ত্বে, বা কোনো প্রেরিত পুরুষে বিশ্বাস করাকেই শ্রেষ্ঠ বলেছেন, হিন্দুধর্ম তা বলেনি। উপনিষদ ঘোষণা করছে, আত্মজ্ঞানই পথ, শাস্ত্রজ্ঞান না। এখানেই ঘোষণা করা হচ্ছে শাস্ত্রের বাণীর অন্ধ অনুসরণ না। কোনো বিশ্বাস কাউকে শুদ্ধ করতে পারে না। সত্য-জ্ঞান-আনন্দের স্ফুরণ যখন এ জগতকে এক সূত্রে দেখাবে, সব ভেদাভেদের ভাব ঘোচাবে তখনই তোমার মুক্তি। তার আগে তুমি খ্যাতি, দেহসুখ আর শাস্ত্রের উপর তোমার আসক্তি ছাড়ো। তোমার একান্ত সাধনা একদিন তাঁর করুণা তোমার চিত্তে বয়ে আনবে, তুমি কৃতকৃত্য হবে।

এ উদার দর্শন কি ভারতীয় সমাজে যথাযথ প্রতিভাত হয়েছে? একদম না! বরং উলটো। নানা অমানবিক, সংকীর্ণ, বর্বরোচিত প্রথা বারবার সমাজে জন্মেছে। আবার এ সমাজই তাকে শুদ্ধ করার ভার নিয়েছে। চৈতন্য মহাপ্রভু থেকে কবীরদাসের মত আলোকস্তম্ভ সেদিন যেমন জন্মেছিল, আজও শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, রমণ মহর্ষির, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, সুভাষের মত মানুষ এ সমাজ, এ ধর্ম থেকেই জন্মেছেন। আবারও সেই প্রাচীন এবং চিরকালীন কথাটাই বলেছে জোর দিয়ে, তুমি নিজে উপলব্ধি করো। ধর্মের সার উপলব্ধির মধ্যে। বিশ্বাসের মধ্যে নয়। তাদের জীবনও সেই আদর্শের প্রতিচ্ছবিই এঁকেছে।

সম্ভলে যা ঘটল, তা দুর্ভাগ্যজনক ও দুঃখজনক। সাঁইবাবার মূর্তিতে যদি তাদের এতই আপত্তি থাকত তবে আরেকটা মন্দির গড়ে দিত না হয়। কিন্তু সে এতদিনের পুজিত মূর্তিকে উৎখাত করে জলে ফেলে দেওয়ার মধ্যে শুধু নিজেদের ক্ষুদ্র-সংকীর্ণ বোধজাত জেদটাকেই রক্ষা করা গেল। সত্যকে না।

স্বামী বিবেকানন্দের প্রবন্ধটির লিঙ্ক -

https://bengaliebook.com/.../%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0

002.jpg