মাথা ঘামাতে চা বা কফির সাহায্য অনেকে নেন, কিন্তু চা আর কফি নিয়ে যদি এই বর্ষায় একটু মাথা ঘামাই কেমন হয়? একে বর্ষাকাল, তায় এবারের এমন ননস্টপ বর্ষা, এমন সময়ে একটু চা-কফির গল্প হয়েই যাক।
চা আর কফির দুটোর ভারতে আসা নিয়ে একটা কমোন যোগসূত্র আছে। কী বলুন তো? দুটোই এসেছিল চোরাপথে। গোপনে। কীভাবে? সেই গল্পই তো করব।
কফির গল্প।
বাবা বুদান। একজন সুফি সাধক। মক্কায় চলেছেন তীর্থে। সালটা আনুমানিক ১৬০০ সালের মাঝামাঝি হবে। তিনি ইয়েমেনের মোকা নামে এক বন্দর শহরে কোয়াহা বলে একটা পানীয় পান করেন, যা আদতে কফি। মোকা ছিল সেদিনের কফির আমদানি রপ্তানির এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। তো সুফি বাবাজী তো মুগ্ধ হয়ে যান তার স্বাদে। বেশ কয়েকবার পান করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন জিনিসটা কী?
এইখানেই সমস্যা। কফির বীজ নিয়ে আরবে ভীষণ কড়াকড়ি আইন ছিল। কোনোভাবেই যেন সে বীজ আরবের বাইরে না যায়, এমনই ছিল বিধান। নিয়ে গেলেই প্রাণদণ্ড। কিন্তু বাবা বুদানের তো সে বীজ চাই-ই। দেশে নিয়ে আসতে হবে। এমন স্বাদ, দেশের মানুষ পাবে না? কী করবেন? ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে সাতটা বীজ নিলেন নিজের দাড়ির মধ্যে লুকিয়ে। সেই বীজ দেশে এনে কর্ণাটকের চিকমাগালুর পাহাড়ে রোপণ করলেন। সেই বীজ থেকে জন্মাল কফিগাছ। শুরু হল ভারতে কফি অধ্যায়ের জন্ম। যা আজকের বিখ্যাত সাউথ ইণ্ডিয়ান কফি। আর সে পাহাড়ের নামও বাবা বুদানগিরি।
যদিও এর মধ্যে কৃষ্ণা গোদাবরী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। অনেক ঘটনাও ঘটে গেছে। বৃটিশরা এসে কফির চাষের বাণিজ্যিক প্রবর্তন শুরু করে। এর মধ্যে আরাবিয়া কফি রোগাক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। রোবাস্টা কফির প্রবর্তন শুরু করে বৃটিশেরা। ভারত আজ কফি উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম স্থানে। এ সবের মূলেই বাবা বুদানের অবদান।
চায়ের গল্প
চায়ের গল্প একদিক থেকে কফির থেকে প্রাচীন, আবার আরেকদিক থেকে কফির থেকে আধুনিক।
ভারতে মূলত দু ধরণের চা উৎপন্ন হয়। দার্জিলিং আর আসাম। আসামের চা শতাব্দী প্রাচীন। জানা যায় যে আসামের আদিবাসীরা চাকে ওষুধ আর বলবর্ধক হিসাবে ব্যবহার করত।
ওদিকে চায়ের সূতিকাগৃহ বলতে চীনকেই জানা যায়। চীন প্রায় দু হাজার বছর ধরে চা পানে অভ্যস্ত। বৃটিশরা অনেক পরে এর স্বাদ পায়। স্যামুয়েল পেপিস নামে একজনের ডায়েরিতে পাওয়া যায়, “চা দারুণ এক পানীয় এবং সকল চিকিৎসক দ্বারা এর পান অনুমোদিত।”
কিন্তু চায়ের ভাগ্য সব সময় সুখকর ছিল না বৃটিশদের জন্যে। চীন চা রপ্তানি করত রূপার বদলে। কিন্তু চায়ের চাহিদা যে হারে বাড়তে থাকে লণ্ডনে সে হারে রূপা জোগান দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না বৃটিশদের। ডাচ অ্যাংলো যুদ্ধে জেরবার অবস্থা। ফলে দুই দেশের বাণিজ্য নীতিতে অসাম্য দেখা দেয়। বৃটিশ একটা উপায় খুঁজে বার করে। বলা ভালো অসদুপায়।
আফিম যুদ্ধ
ভারত বাংলায় আফিম চাষ শুরু করে। সেই আফিম পাঠাতে শুরু করে চীনে চোরাপথে। তার বিনিময়ে চা। আফিমের ইতিমধ্যেই বিরাট চাহিদা ছিল চীনে। ফলে আফিমের চোরাকারবার কিছুদিনের মধ্যেই লাভের মুখ দেখল। চীনের রূপার ভাণ্ডারে টান পড়ল। ওদিকে স্বাস্থ্যের উপরও কুফল পড়তে শুরু করল। চীন বাধ সাধল। লাগল যুদ্ধ। দু দুটো আফিম যুদ্ধ হয়ে গেল চীনের সঙ্গে। দুটোতেই চীন হারল। একটা ঘটল ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২। আরেকটা ঘটল ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০।
ইতিমধ্যে ইংরেজরা ভারতে ১৮৩৯ সালে প্রথম আসাম চা কোম্পানি খুলে ফেলেছে। লর্ড বেন্টিঙ্ক ইতিমধ্যেই উৎসাহ দেখিয়েছেন চা নিয়ে। ১৮২০ সালে ইংরেজরা যখন প্রথম আসামের চায়ের সন্ধান পান তখনই বুঝতে পারেন এটা চীনের চায়ের মতই কিছু একটা, সম্পূর্ণ এক জাতের না হলেও। দার্জিলিং এও চাষের ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেল ১৮৪১ সালের কাছাকাছি।
চায়ের চোরাচালান
এরমধ্যেই ঘটে গেল একটা ঘটনা যার সঙ্গে বাবা বুদানের কফি চোরাচালান গল্পের মিল। ১৮৪৮ সালে একজন স্কটিশ হর্টিকালচারিস্ট রবার্ট ফরচুন গোপনে ছদ্মবেশে চীনে প্রবেশ করেন। সঙ্গে ওয়াং। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চা বাগান পরিদর্শন করেন। চা চাষের কৌশল ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেন। ফরচুন বেশ কিছু চারা আর বীজ সংগ্রহ করে কাঁচের বোতলে ভরে হংকং থেকে কলকাতায় পাচার করে দেন।
এরপর ইংরেজ সাম্রাজ্যে চায়ের এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। ক্রমে চা’কে সুকৌশলে ভারতের একদম সাধারণের স্তরে পৌঁছে দেওয়ার নানা বাণিজ্যিক পদ্ধতি নেওয়া হয়। রাস্তায়ঘাটে, বন্দরে, স্টেশানে চায়ের গল্প জমে ওঠে। ভারতে চায়ের অধ্যায় শুরু হল। এখনও রাণাঘাট, নৈহাটি, দমদম ইত্যাদি রেলওয়ে স্টেশানে সেদিনের সচিত্র বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। আর আধুনিক ভারত? সে আজ চা উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে।
প্রাচীনত্ব
অনেকের মতে চায়ের উল্লেখ রামায়ণে আছে। কড়াহ্ বা কাশ্যয় বলে যে পানীয়ের কথা উল্লেখ আছে আসলে তা চা।
তাছাড়াও চড়ক আর সুশ্রুত সংহিতায় যে কাশ্যম এর উল্লেখ আছে তা একেবারে আজকের দিনের চায়ের মত না হলেও চায়ের সঙ্গে তার মিল আছে বলেও অনেক গবেষক মনে করেন।
অর্থাৎ কফি হোক বা চা, দুজনেরই ইতিহাস বড় রোমাঞ্চকর। বাবা বুদান কী রবার্ট ফরচুন, দুজনের কাছেই আমাদের সকাল, দুপুর, বিকেল সন্ধ্যে, মাথাধরা, মাথাঘোরা, আলোচনা, বিষাদ, একাকীত্ব…..ইত্যাদি ইত্যাদি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। রবি ঠাকুর চা চক্র সমিতির গানে লিখছেন….
হায় হায় হায় দিন চলি যায়।
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল’ চল’ চল’ হে।।
টগ’বগ’-উচ্ছল কাথলিতল-জল কল’কল’হে।
এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ।।
শ্রাবণবাসরে রস ঝর’ঝর’ ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে।
এস’ পুঁথিপরিচারক তদ্ধিতকারক তারক তুমি কাণ্ডারী।
এস’ গণিতুধুরন্ধর কাব্যপুরন্দর ভূবিবরণভাণ্ডারী।
এস’ বিশ্বভারনত শুষ্করুটিনপথ- মরু-পরিচারণক্লান্ত।
এস’ হিসাবপত্তরত্রস্ত তহবিল-মিল-ভুল-গ্রস্ত লোচনপ্রান্ত ছল’ছল’ হে।
এস’ গতিবীথিচর তম্বুরকরধর তানতালতলমগ্ন।
এস’ চিত্রী চট’পট’ ফেলি তুলিকপট রেখাবর্ণবিলগ্ন।
এস’ কন্স্টিট্যুশন- নিয়মবিভূষণ তর্কে অপরিশ্রান্ত।
এস’ কমিটিপলাতক বিধানঘাতক এস’ দিগভ্রান্ত টল’মল’ হে।।