যেনতেনবাবুর যা দেখেন বিচ্ছিরি লাগে। খুব বাজে লাগে যখন শৌচালয়ে যান। মূত্রাশয় খালি করে এসে ক্ষণিকের স্বস্তি পান। আবার সব বিচ্ছিরি লাগে। জগতে কোথাও যেন শ্রী নেই।
একটা সরু গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামতা পড়ছেন। নামতা পড়তে পড়তে একজন সিরিয়াল কিলারকে খুঁজছেন, যে এই অন্ধকার গলিতে কোনো কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে, যাকে বলবেন, সব কটাকে খুন করে দে। এ শহর লাশের শহর হোক। তারপর সব তোর।
নেই। একটা ঘেয়ো কুকুর মৃত্যুর অপেক্ষায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিচ্ছিরি!
মানুষ বিচ্ছিরি হয়ে গেছে। জীবন বিচ্ছিরি হয়ে গেছে। অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। বিচ্ছিরি লাগাটা দীঘির জলের মত ভিতরে টলটল করছে।
“কাকু একটা লজেন্স কিনবে? দশ টাকায় কুড়িটা।”
একটা বাচ্চা। কালো। নীল গেঞ্জি। হলুদ হাফপ্যান্ট। মুখটা নিটোল। যেন কুমোরটুলি থেকে বানানো। বয়েস এগারো কি বারো হবে।
বাচ্চাটার কাছ থেকে কিনলে বাচ্চাটা সুখ পাবে। নিজেরও সুখ হবে। কিন্তু সে সুখের স্থায়িত্ব কতটুকু? কী হবে মিথ্যা সুখ চাখিয়ে ওকে, নিজেকে? তার চাইতে মাত্র কয়েকটা বিক্রি হোক। ব্যর্থতা নিয়ে বাড়ি যাক। রোজ রোজ ব্যর্থ হোক। মানুষের উপর বিশ্বাস হারাক। বিচ্ছিরি লাগতে শুরু করুক সব। ঠিক থাকবে। বিচ্ছিরি লাগাটাই খাঁটি অনুভব একমাত্র।
ছেলেটা চলে গেল। কেউ কেউ কিনছে। মুখে পুরছে লজেন্স। তৃপ্তি পাচ্ছে। করুণা করার তৃপ্তি। ভালো কাজ করার তৃপ্তি। ছেলেটাও খুশি হচ্ছে। সফল হওয়ার সুখ পাচ্ছে।
=======
অন্ধকারে বসে আছেন যেনতেনবাবু। গোটা সংসার জুড়ে এখনও বেচাকেনা চলছে। নিষিদ্ধ বেচাকেনা। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে হয় তো এতক্ষণে। স্বপ্ন দেখছে আসল জীবনের। খাঁটি জীবনের। একটা সূত্র খুঁজছে, যে সূত্র মেনে অঙ্ক মেলালে জীবন খাঁটি হয়। সুখ স্থায়ী হয়। একদিন বুঝবে কোনো সুত্র ছিল না কোনোদিন। জীবন বিষণ্ণ করবে বলেই সুত্রের মরীচিকা বুনে রাখে। অবশেষে সব বিচ্ছিরি। সূত্রহীন সব। কীসের মানে বুঝবে? কী বোঝার আছে? বুঝতে চাওয়াই এক ভ্রম!
আজকাল প্রায়ই রাতে ঘুম আসে না। ভোরের দিকে ঝিম ধরা ঘুম আসে একটা। এক একদিন এক এক সূত্রহীন মানুষের মুখ মনে আসে। আজ আসছে বোনের কথা।
বোন। মুক্তা। গোটা জীবন সংসারে নিজের পাঁজর দিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে এখন ভাঙা পাঁজরের টুকরো খুঁজে বেড়াচ্ছে। মূর্খ মেয়েছেলে। ছেলেগুলো দেখে না। বরটা উদাসীন। বোনটা বুঝেছে গোটাগুটি ঠকে গেছে। চুষে ছিবড়ে করে দিয়েছে সংসার। সবটা নিয়েছে। সব সময়টা নিয়েছে। সামনে মৃত্যু। কালো দেওয়াল। পিছনে হারানো পাঁজরের টুকরো। পাবে না। সেও জানে। সব সুত্র ব্যর্থ। সুখী নিটোল জীবন…. ওসব হয় নাকি?
=======
যেনতেনবাবুর ঘুম এলোই না। ছেলেটার মুখটা জ্বালাচ্ছে। তার লজেন্সগুলো কামড়াচ্ছে ছারপোকার মত। সকালবেলা আবার বড় রাস্তার মোড়ে এসে বসলেন। বেঁচে থাকার কোনো সূত্র নেই। কিন্তু সূত্র খোঁজে কে? চিন্তা। সে একটা নিয়মে ফেলে সব দেখতে চায়। বুঝতে চায়। চিন্তা করে কে?
আগে সব ভালো ভালো চিন্তা আসত। এখন সব বিচ্ছিরি চিন্তা। কে করে চিন্তা? আমি তো নই। আমার মাথার মধ্যে বসে কে চিন্তায়? সমুদ্রের ঢেউয়ের মত চিন্তার ঢেউ এসে পড়ে আমার উঠানে। কে চিন্তা করে? আগে ভালো চিন্তা ছিল। সূত্রের পর সূত্র তাকে তাকে ভরা ছিল। এখন সব তাক শূন্য। ঝুলে জালে ভরা। কে চিন্তায়? কে? কে?
ছেলেটা আসবে না আজ? কিন্তু কেন অপেক্ষা করছেন ছেলেটার জন্য? স্পষ্ট নয়। মনে হয় এই বিচ্ছিরি হতশ্রী জগতে সব গেলেও কোথাও একটা উচিত বোধ কাকের মত ডেকে ওঠে মানুষের মনে। সুখ দেয় না। সজাগ করে। কাকের ডাকে সুখ নেই। জাগরণ আছে। অনেকে বলে পরলোকে যাওয়া মানুষ এ লোকে কাক হয়ে এসে পিণ্ড খেয়ে যায়। হতে পারে। কাকের মধ্যে একটা লোকান্তরিত হয়ে বাঁচার ক্ষমতা আছে। নইলে এত জঞ্জাল এত যুগ যুগ করে হজম করে আসছে কী করে?
দেখতে দেখতে একটা কাক এসে বসল সামনে। কা কা করে ডেকে উঠল। চিন্তার ঘোর কেটে যেনতেন বাবু দেখলেন ছেলেটা আসছে। মাথায় লজেন্সের গামলা। দশ টাকায় কুড়িটা। ছেলেটা আসছে। তার পিছনে ভোরের আলো ফুটছে ধিমিধিমি তালে। কাকটা ডাকছে। প্রায়শ্চিত্ত করতে বলছে যেন।
বিচ্ছিরি চিন্তারা রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে। একটা কাক মনের মধ্যে ডাকতে ডাকতে এগোচ্ছে। উড়ছে না। কাকেরাই ঢিল ছুঁড়লে দূরে গিয়ে বসে। আবার ডাকে। জায়গা ছেড়ে যায় না। সুখী মানুষ বিরক্ত হয়। দুঃখী মানুষ ভয় পায়। বিচ্ছিরিতে বাঁচা মানুষ রাস্তা ছেড়ে দেয়। তাকে ডেকে বলে, এসো। এসো। চিন্তা ছেড়ে যাবে না। তুমি চিন্তার সুতো ছিঁড়ে দাও খালি। ডাকো ডাকো। ইহলোকে পরলোক থেকে ডাকো। আমাকে রক্ষা করো। আমি নিজেই আমার শয়তানির শিকার হয়ে বসে আছি। নিজেকে সম্পূর্ণ গিলে ফেলতে চাইছি আমি নিজেই। আমাকে বাঁচাও।