মনের মধ্যে দমচাপা ঘর কার না থাকে? সে ঘরে যেতে ভয়। সে ঘরে জুজুবুড়ির বাস। সে ঘরে একবার সেঁদোলে বেরোবার পথ পাওয়া দায়। সেখানে অনেক অপমান, অনেক ক্ষোভ, অনেক বিষজ্বালা। সে ঘরে অনেক অপূর্ণ সাধের দীর্ঘশ্বাস, অনেক স্বপ্নের জ্যান্ত কবর, অনেক অভিমান জমা জঙ্গলের একাকীত্ব।
সে ঘরে আমরা বড়ো একটা ঢুকি না। থাক বাবা। সে সাহস কে দেখাবে? খুঁচিয়ে ঘা করে কি লাভ বলো? কিন্তু যাব না বললেই তো হয় না, সে ঘরে না যাই, সে ঘরের অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করি এমন নির্বোধও তো নই। সে ঘরের তাপ আসে তো মাঝে মাঝেই আমার বসার ঘরে, শোয়ার ঘরে, স্নানের ঘরে।
সে ঘরে ঢোকে কে তবে? দু'জন। গভীর আনন্দ আর গভীর দুঃখ। এই দুটো অনুভূতিতে আমরা সে ঘরে ঢোকার সাহস পাই। তাই দুটোতেই চোখে জল।
গভীর সুখ জন্মালো বুকে। পাগল করা আনন্দ; বা আনন্দে পাগল, আত্মহারা। দড়াম করে ঢুকলাম সে ঘরে। চীৎকার করে বললাম, "আমি আছি, তবু আছি এই দেখো... আমি আনন্দেই আছি... কে বলল আমার সব হারিয়েছে? এই তো দেখো আমার বুকে ফুটন্ত সুখ..."
এতে কাজ হয়। কিছু বাষ্প সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিছু দীর্ঘশ্বাস ওই আনন্দের সাথেই গলে জল হয়ে বেরিয়ে যায়, মিলিয়ে যায়।
কিছুটা তবু থেকেই যায়। ওরা তো থাকবেই। না হলে ভারসাম্য নষ্ট হবে যে মনের।
গভীর দুঃখেও সে ঘরে আসি। পা টিপে টিপে চোরের মত। যাতে ওরা জেগে না যায়। ঘরটার একটা কোণায় বসে দেখি। চুপ করে দেখি। অতীতের কত অপমান, কত ক্ষোভ, কত অব্যক্ত যন্ত্রণা স্তরে স্তরে সাজানো। আবার আমার কোলেও আজ একটা আরো নতুন অপমান, কিম্বা ক্ষোভ, কিম্বা সেই না বলতে পারা যন্ত্রণা, যাকে এই ঘরটার কোনো এক কোণায় স্থান দেব বলে নিয়ে এসেছি। কতক্ষণ একা বসে কাটে তার কোনো হিসাব থাকে না। বাইরের আকাশের রঙ পালটায়, ঘরের লোক কাজে যায়, কাজের থেকে ঘরে ফেরে – আমি নির্বিকার। আমি যে সেই দমচাপা ঘরে গো... ডাকলে বুঝি... ডেকো না এখন... এখন আমার সাড়া দেওয়ার মনটা নেই যে... সে মুখ ফিরিয়ে আমারই মুখের দিকে তাকিয়ে বসে... দমচাপা ঘরে...
তারপর কোনো এক ক্ষণে বেরোতেই হয় সে ঘর থেকে। তালা লাগিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াই। জমা কাজে হাত দিই। ভাগ্যিস সংসারে কাজটা বড়, মনটা না। না হলে চোখে পড়ত হয়তো... মনের গায়ে কালশিটে... জল জমেছে নাভির চারপাশে... মনের বুকের ভিতর ভীষণ শ্বাসকষ্ট...
কারোর চোখে পড়ে না ভাগ্যিস। সেখানে আমি যন্ত্র, মানুষের মত যন্ত্র। ভালোবাসাও যন্ত্রের আওয়াজের মত একটা বাই-প্রোডাক্ট। পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই। কাজটা হলেই হল। এই সময়গুলোতে এই যন্ত্র হতেই ভালো লাগে। সংসারে আমার দমচাপা ঘরের জিনিস তার নিজের দমচাপা ঘরে নেবে – এমন মানুষ কোথায়? সবারই যে ঠাসাঠাসি ঘর। তাই বুকের কথা সহসা কারো কাছে ফাঁস করে কি লাভ?
তবে সে ঘরে যে সহজেই ঢুকে যেতে পারে, তাকে আটকিয়ে রাখার জো কারোর নেই, এ আমাদের সকলের অভিজ্ঞতা। যেমন আমাদের পঁচিশে বৈশাখ... সে তো আমাদের সব ঘরে ঢুকে বসে। তাকে আসতে মানা করি এমন ক্ষমতা কার আছে? আমরা তাকে ডেকেই তো বলি... অনেকদিন চোখজোড়া শুকনো... আমায় কাঁদাও দেখি... “দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো”...
আর যাদের এই পথ নেই, তারা নিতান্তই দুর্ভাগা। এর ওর কাছে কেঁদে-কঁকিয়ে তার সে দমচাপা ঘরে ঠেলে ঢোকাতে চায়... আর বলে, "আসুন না... দেখে যান... আপনি ছাড়া আমার এমন সুহৃদ আর কে আছে গো!" (এখানে একটা কথা বলে রাখি...যারা শুধু ওই ঘরের দিকে ঠেলার জন্যেই সুহৃদ খোঁজেন... তাদের কাছে প্রত্যেকেই যেন এক এবং অদ্বিতীয়ম এমনধারা ভাব করে থাকেন... খবরদার! সে ফাঁদে পা দিয়েছো কি মরেছো... তুমি ছাড়া সে ঘরে সেঁধুবার আর লোক নাই একথা মনেও স্থান দিও না। ঠকবে।)
সে ঘরের একটা রহস্য আছে। সে ঘরের তাপ কমাবার এক রহস্যময় উপায় জানি। বলি?
অন্য ঘরগুলোর পরিমাপ আর পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। ওই ঘরটার বোঝা তখন অনেক কম। এবারের প্রশ্ন অন্য ঘরগুলোর মাপ আর সংখ্যা বাড়াবো কি করে?
খুব সোজাও না, আবার কঠিনও না। বই পড়ুন। নানান জীবনের বই পড়ুন। দেশ বিদেশের মানুষের কথা পড়ুন। বড় বড় চিন্তাবিদদের কথা পড়ুন আর ভাবুন।
আমরা ভাবি, আরে অত বড় বড় মানুষের কথা কি আর আমরা ছাই বুঝব? আচ্ছা বলুন দেখি, ওরা বড় হলেন কেন? কঠিন কথা বলেছিলেন বলে? না বহু মানুষের কথা একা নিজেই বলেছিলেন বলে। আপেল কেন মাটিতে পড়ে আমার না জানলেও জীবনটা ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ দেখি নে, কিন্তু মনের কথা যারা বলে গেছেন, মানুষের কথা যারা বলে গেছেন তাদের কথায় না স্নান করলে প্রতিদিন, গায়ে গন্ধ হবে যে!
সৌরভ ভট্টাচার্য
27 September 2016