শেফালি যখন কাশী স্টেশানে রাত আড়াইটের সময় নামল তখন তার বয়েস সাতষট্টি বছর, চারমাস, তেরোদিন।
মারণ রোগ নিয়ে শেফালির নাতনিটা যেদিন তার বাড়ি এসেছিল, সেদিন নাতনির বয়েস ছিল বত্রিশের কোটায়। তার সদ্য পঁয়ষট্টি। সেদিন সকালেই সে ভাবছিল, এ সংসারে তার দায়িত্ব ফুরিয়েছে। তার নিজের দুই ছেলে, তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার। ভাত কাপড়ের অভাব নেই, কিন্তু যেটার অভাব, সেটা না থাকলে প্রাণ শরীর ছেড়ে যায় না। শান্তি যায়।
মনে শান্তি ছিল না শেফালির। রোগ ধরা পড়ার পর নাতনিটারও ছিল না তার শ্বশুরবাড়ি। শেফালির মেয়ের ঘরের মেয়ে সে। মেয়ে জামাই মরেছে অনেকদিন হল। তার স্বামীটা অমানুষ। সে নিঃসন্তান।
নাতনি ঘরে আসার পর ছেলেরা বলল, নিজেরটা নিজে বুঝে নাও। ওর খরচ আমাদের না। তোমার।
শেফালি তার চিকিৎসার ত্রুটি রাখেনি। পথ্য দিতে পারেনি উপযুক্ত। মেয়েটা মরল মহালয়ার পরের দিন। শেফালি ঘর ছাড়ল তারপরের দিন। এখানেই কাজ সারবে নাতনির।
=======
শেফালি কোনোদিন ভিক্ষা করেনি। কিন্তু যেদিন প্রথম ভিক্ষার টাকায় ভাত ডাল আর একটা তারকারি কিনে খেল, মনে হল এই প্রথম তার আত্মাও দুটো ভাত পেল। এমন তৃপ্তিতে ঘুম থেকে গঙ্গার ধারে জাগল সন্ধ্যেবেলা, যেন তার স্বামী তার পাশেই শুয়ে। একটা কুকুর শুয়ে ছিল। শেফালি উঠে বসে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করল মা গঙ্গাকে, বিশ্বনাথকে আর স্বামীর ভিটেকে।
নাতনির কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু মৃত্যুর জন্য নিজের বাড়িতে ফিরতে আর ইচ্ছা নেই। ভয় নেই, বিতৃষ্ণাও নেই। অপমানবোধটাও নেই। আসলে কোনো সাড় নেই। না বাড়ির, না নাড়ির। শেফালির মনে হয় অনন্তকাল ধরে যেন সে এখানেই আছে। এখানেরই কোনো গলিতে জন্ম তার।
=======
সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। কদিন ধরেই হচ্ছে। ঘাট বাট সব ডুবে। এক জায়গায় ভাণ্ডারা আছে দুপুরে তাই শেফালির আজ ভিক্ষার তাড়া নেই। তবু বসে আছে। কেউ কিছু দিক না দিক, তাকাক না তাকাক, এই রাস্তার ধরে বসে থাকার যে এমন সুখ, ঘরের দাওয়ার চাইতে, তা আগে যদি জানত!
একজন রাস্তার ওপার থেকে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। কাশী আসার পর অনেক চেনা লোকের মুখোমুখি হয়েছে, তারা কথা বলতে চেয়েছে, ডেকেছে….সে সাড়া দেয়নি। তাকায়ওনি মুখের দিকে। রাস্তায় নামলে আবার লৌকিকতার কীসের দায়?
কিন্তু ও কে? চোখে ভালো দেখে না। সে হঠাৎ এগিয়ে এলো। এসে বলল, তুমি যতীনের বউ না? চাকদার, ক্লাবের ধারে তোমাদের বাড়ি না?
সে উত্তর করল না। যেন শুনতে পাচ্ছে না।
সে উবু হয়ে বসে বলল, তোমার বড় ছেলে স্ট্রোক হয়ে মরেছে….খবর পেয়েছ? ছোটোটা তো নেশায় চুর হয়ে থাকে। যাও, যাও। হাল ধরো গিয়ে। নইলে শকুন ছুঁকছুঁক করছে। ভিটেবাড়ি সব যাবে।
======
মুষলধারে বৃষ্টি। যেন আকাশ আর মাটির মধ্যে জল ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক ছিল না কোনোদিন। শেফালি বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। দরজায় মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তার বড় ছেলে কই? ওই তো রোদে শুকানো কাঁথা, ওই তো তার বমিহাগা মাখা তার মাটির মেঝে, ওই তো তার খাট ধরে ধরে হাঁটা ছোটো ছোটো ভিজে পায়ের ছাপ।
একজন বলল, মা কী হয়েছে? সন্তানশোক?
তারই একজন চেনা সহ-ভিখারি। সে বৃদ্ধের জন্ম সত্যি সত্যিই এই কাশীতে।
সে বলল, মা এ কান্না আমি চিনি…বাবার এখানে প্রায় নব্বইটা বছর কাটল। তুমি শান্ত হতে যেও না। বাবা যেদিন শান্ত করবেন সেইদিন শান্ত হোয়ো। এখন পোড়ো। মরলে তো শুধু হাড়মাসের খাঁচাটা পোড়ে মা, জ্যান্ত থাকতে মানুষ পোড়ে তার চাইতে হাজার গুণ তাপে। তুমিই তোমার ডোম মা, তুমিই তোমার কাঠ, তাপ। তুমি পুড়তে পুড়তে শান্তির নাভিকুণ্ড খুঁজে বেড়াচ্ছ। এই তো জীবন মা!
=====
আপ রাণাঘাট লোকালের প্রথম লেডিস কম্পার্টমেন্ট থেকে যখন চাকদাহ স্টেশানে রাত দশটা এগারোয় নামল শেফালি তখন তার বয়েস আটাত্তর বছর, চার মাস, ন দিন। নেমে মন্দিরের পাশেই বারের ঠাকুরের কাছে দাঁড়ালো। প্রণাম করল। টোটোতে উঠল। বলল, শ্মশানে চলো।
টোটোওয়ালা মুখের দিকে তাকালো।
শেফালি বলল, আমার পরিবারের অর্ধেকের বেশি আছে ওখানে। চলো। ভাড়া দেব, ভয় নেই। নাকি আগেই নেবে।
টোটোওয়ালা বলল, নাহ, এরকম তো শুনিনি আগে। চলুন। তাই বলে শ্মশানে?
শেফালি অস্ফুটে বলল, বাবা গোটা সংসারই মণিকর্ণিকার ঘাট। তোমার বোঝার বয়েস হয়নি। তাই ছাইয়ের মূল্য জানো না। আমার মতো হও, বুঝবে।