Skip to main content

 

যে জগতে কোনো নোটিফিকেশনের লাল দাগ, শব্দ নেই…. যে জগতে কোনো রিয়্যাক্ট দেওয়ার হাতছানি নেই, বাধ্যতা নেই….. যে জগতে কোনো অক্ষর নেই…. নাচ, গান, অভিনয় নেই……

সেই জগতে আমি কতটা সৎ? কতটা উদার? কতটা সংবেদনশীল?

ভার্চুয়াল শব্দের মানে অভিধান করেছে, “not physically existing as such but made by software to appear to do so”.

অর্থাৎ প্রযুক্তি নির্মিত জগত। আগে ছিল জগতের সম্বন্ধে পরিমাপযোগ্য, পরীক্ষাযোগ্য জ্ঞানের পদ্ধতি বিজ্ঞান। জগতের বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে ধরে জন্মালো প্রযুক্তি। তারপর প্রযুক্তি বানালো বিনোদনের‍, নিত্য জীবনের সুবিধার, চিকিৎসার, জ্ঞান আরোহনের নানা উপাদান। এখন প্রযুক্তি বানাচ্ছে সমাজের অনুকরণে আরেকটা সমাজ। সিটিজেন থেকে নেটিজেনে উত্তরণ। প্রযুক্তি বদ্ধ সমাজ না, প্রযুক্তি নির্মিত সমাজ। প্রযুক্তি আগেও সমাজকে বেঁধেছে দ্রুত যানবাহনে, ফোনে ইত্যাদিতে। কিন্তু প্রযুক্তি চিন্তা-আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা রাখত না। আজকে AI যা পারছে।

এর থেকে মুখ ফেরানোর কথা বলা মানে প্রলাপ বকা। এ লেখাটাও এইখানেই লিখছি। ওই শঙ্করাচার্যের মত বলতে চাইছি, শব্দজালং মহারণ্যং চিত্তভ্রমণকারণম - শব্দের জাল গভীর অরণ্যের মত যা চিত্ত বিভ্রমের কারণ।

এ কথাও শঙ্করাচার্য শব্দের মাধ্যমেই বুঝিয়েছিলেন। তেমনই এ কথাগুলোও এখানে বললে দোষের হয় না, কারণ মহাজনের পথ অনুরসরণ করাই বিধান।

কিন্তু এ কথা হঠাৎ কেন বলছি?

প্রযুক্তি নির্মিত জগত অসীম। কিন্তু বাস্তব জগত সীমাবদ্ধ। খুব ছোটো পরিমণ্ডলে যাতায়াত সেখানে। যদি না তিনি সেলিব্রিটি হন। কিন্তু সাধারণ মানুষের গোটা জীবনে আর ক'টা মানুষ সঙ্গে ওঠাবসা হয়? নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের একটা ছোটো বৃত্তে জীবন কেটে যায়। আনন্দে কেটে যায়। পরিপূর্ণতায় কেটে যায় যদি বাঁচতে জানি তো। সেই ছোটো পরিবৃত্তে আমি কতটা সৎ? কতটা অ্যাভেইলেবল? কতটা অ্যাপ্রোচেবল? সেখানে কি আমি দায়সারা? নিজেরটুকু হলেই হয়ে যায়? সেখানে কি আমি অন্যের কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক? সেখানে কি আমি সাফোকেটিং?

ছোটো জায়গায় হীন চিন্তা, হীন উদ্দেশ্য খুব জোরে বাজে না। নিজের একটা ছোটো ঘর নোংরা করেও রাখা যায়, আবার পরিষ্কার করেও রাখা যায়। কিন্তু শপিংমলের বেলায় তা হয় না। তেমনই ছোটো বৃত্তে আনায়াসে হীন হতে পারা যায়। কিন্তু প্রযুক্তির মঞ্চে সেটা সম্ভব হয় না। সেখানে সম্পর্কহীন হাজার মানুষের অহর্নিশি খুঁতখোঁজা শোঁকাশুঁকি চলছে। সেখানে সাবধানী মানুষ। অতিসাবধানী। তাই কৃত্রিম। সেখানে নকলে-আসলে পার্থক্য করার দায় নেই, সেখানেই তুবড়ির মত জ্বলে থাকার সময়সীমাই আসল। সেটাই বাহবা পাওয়ার মূল মাপকাঠি।

যে পুরোহিত নিজের বাড়ির পুজো নমো নমো করে সারে, তাকেই দেখেছি দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলে মাইকের সামনে অতি সাবধানী হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। এটাই স্বাভাবিক মানুষের প্রকৃতি।

কিন্তু এরপরেও কিছু কথা আছে। তা হল ওই ছোটো বৃত্তটায় খাঁটি না থাকলে বাকি সব জায়গায় বানানো প্রাসাদ অল্প হাওয়াতেই ভেঙে পড়ে। মানুষে মানুষে খাঁটি সম্পর্ক যে গুণের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার নাম - আস্থা। আস্থা ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক মানসিক সাম্য রাখাই কঠিন, বাকি সুখ-আনন্দ তো দূরের ব্যাপার।

এইখানে একটা ফাঁক তৈরি হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে আস্থা চর্চার অভ্যাস কমে আসছে। প্রযুক্তি নির্মিত জগতে বা ভার্চুয়াল জগতে আস্থা শব্দটা গৌণ, সেখানে অনুসরণকারী, ফ্যান, ফলোয়ার ইত্যাদি লাভ-লোকসানের সংখ্যার হিসাব। আস্থা চর্চা সেখানে সম্ভব না। তাই দেখছি আধুনিক প্রজন্মের বাচ্চাদের মধ্যে যারা ভীষণভাবে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা, তাদের বাস্তবজগতে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করতে আস্থা বা ট্রাস্ট একটা ইস্যু হচ্ছে। এটা কিন্তু মানবপ্রকৃতি না। একটা আস্থাভাজন সম্পর্ক হাজার একজন ফলোয়ারের তুল্যও নয়। একটা আস্থাভাজন সম্পর্ক না থাকলে, লক্ষ লক্ষ ফলোয়ারও আমার মানসিক সাম্য ঠিক রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। আমার প্রকৃতিতে বিকার জন্মাবেই।

মানুষ চাইলে অনেক কিছু বদলাতে পারে কিন্তু মানবপ্রকৃতির বাইরে যেতে পারে না। এই মানবপ্রকৃতির ধারণায় সন্দেহ করে এক সময়ে কিছু অতিবুদ্ধিজীবী বৌদ্ধিক জগতকে অনেকটা বিভ্রান্ত করেছেন এক সময়ে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সে যুগ আমরা ফেলে এসেছি। কিন্তু আজ এই প্রযুক্তি নির্মিত জগত মানুষের পারস্পরিক আস্থা চর্চার অনুশীলনকে গৌণ করে যে ইগোকেন্দ্রিক বিনোদনের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে তা মানুষের প্রকৃতির জন্য একদমই স্বাস্থ্যকর নয়।

আমার চারপাশের বাস্তব জগতের কয়েকটা সম্পর্ক নিয়ে তৈরি ক্ষুদ্র গণ্ডী আমাকে হীন হওয়ার অবকাশ দিলেও, আমাকে হীন হওয়ার পরামর্শ দেয় না। আমি যদি এই ক্ষুদ্র গণ্ডীতে সৎ থাকি, সংবেদনশীল থাকি, দায়িত্ববান থাকি তবে সে-ই আমার আসল কর্তব্য। আমার জীবনের সার্থকতা। সে আমি সেলিব্রিটি হই চাই না হই, পুরষ্কার, উপঢৌকন, নাম, খ্যাতি ইত্যাদি পাই চাই না পাই। ওইটুকুই আমার দাবিদাওয়ার জগত। আমার আমিকে গড়ে তোলার জগত ওই কজন মানুষের উপর সৎ থেকে, সংবেদনশীল থেকে। গোটা জগতের উদ্ধারকর্তা হওয়ার দায় আমার নেশা। স্বয়ং খ্রীষ্টই এসব সোশ্যালমিডিয়া আসার আগে বলছেন শুধু পাশের মানুষটাকে ভালোবাসার কথা, সেই তার চূড়ান্ত আদেশ। কমেন্ডমেন্ট। জগতকে ভালোবাসা তো কাব্যিক আবেগ, নয় তো ফ্যাটি ইগো সিণ্ড্রোম। বাস্তব না। স্বাস্থ্যকর তো নয়ই।

আজ সমাজের ভিতটাই প্রশ্নের মুখে। আস্থা একটা ধ্রুব অচল কিছু না। আস্থা একটা অনুশীলনের গুণ। অর্জন করতে হয়। আমার জীবনে যাবতীয় যা কিছু অর্জন অর্থহীন হয়ে যেতে পারে শুধু সম্পর্কের আস্থাহীনতায়। শারীরিক মৃত্যুর থেকে ভয়ংকর সে মৃত্যু। হাজার মানুষের মধ্যে থেকে একাকীত্ব যে কী কঠিন মৃত্যু সে আশেপাশে ভালো করে তাকালেই দেখা যায় কীভাবের এর শিকারের পরিমাণ বাড়ছে সমাজে।

এত কোলাহল ছাপিয়ে এইটুকুই শুধু বলতে চাই, নিজেকেও বলতে চাই, ওই ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে যদি নিজেকে আস্থাভাজন করে বাঁচতে না পারি, তবে শেষে সবটাই ফাঁকি। ফাঁকির ফল কখনও মিঠেও হয় না, তিতেও হয় না, শূন্য হয়। মৃত্যুর আগে শূন্যতার সঙ্গে সহবাস কোটি মৃত্যুতুল্য।