দ্বিতীয় গল্প
=========
এক গ্রামে দুই বিদ্যাবাগীশ খুড়ো ছিলেন। ইহারা দুই সহোদর। জ্যেষ্ঠ নৈয়ায়িক, কনিষ্ঠ স্মার্ত (দুই ভিন্ন দর্শন অবলম্বী শাস্ত্রবিশেষ)। একদিন এক ব্যক্তি ব্যবস্থা জানিতে গিয়াছিলেন। স্মার্ত বিদ্যাবাগীশ বাটিতে নাই শুনিয়া তিনি চলিয়া যাইতেছেন দেখিয়া, নৈয়ায়িক বিদ্যাবাগীশ জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি জন্যে আসিয়াছ। তিনি কহিলেন, আমার একটি তিন বৎসরের দৌহিত্র মরিয়াছে; তাহাকে পুতিব বা পোড়াইব ইহার ব্যবস্থা জানিতে আসিয়াছি। নৈয়ায়িক অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কহিলেন, তাহাকে পুতিয়া ফেল। সে ব্যক্তি জানিতেন তিন বৎসরের ছেলেকে পোড়াইতে হয়, পুতিতে হয় না; তথাপি সন্দেহ করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছিলেন। এক্ষণে পুতিতে হইবে, এই ব্যবস্থা শুনিয়া তিনি সন্দিগ্ধ মনে ফিরিয়া যাইতেছেন; এমন সময়ে পথিমধ্যে স্মার্তের সহিত সাক্ষাৎ হইলে জিজ্ঞাসিলেন, পুতিব না পোড়াইব। তিনি পোড়াইতে বলিলেন। তখন সে ব্যক্তি কহিলেন, তবে বড় মহাশয় পুতিতে বলিলেন কেন। স্মার্ত, জ্যেষ্ঠের মান রক্ষার জন্য কহিলেন, তিনি পরিহাস করিয়াছেন। অনন্তর তিনি বাটীতে গিয়া জ্যেষ্ঠকে কহিলেন, কি বুঝিয়া আপনি এমন ব্যবস্থা দিলেন। পোড়াইবার স্থলে পুতিতে বলা অতি অন্যায় হইয়াছে। নৈয়ায়িক কহিলেন, আমি অনেক বিবেচনা করিয়াই পুতিতে বলিয়াছি। পুতিয়া রাখিলে যদি পোড়াইবার দরকার হয় তুলিয়া পোড়াইতে পারিবেক; কিন্তু যদি পোড়াইতে বলিতাম তখন পোড়াইয়া ফেলিলে যদি পুতিবার দরকার হইত তখন কোথায় পাইত।
তৃতীয় গল্প
=========
কোনও বিখ্যাত অধ্যাপকের চৌপাড়ীতে (টোল) দশ-বার বৎসর থাকিয়া খুড়র মতন বুদ্ধিমান এক ব্যক্তি সমগ্র স্মৃতিশাস্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন। তিনি পাঠ সমাপ্ত করিয়া স্বগ্রামে আসিলে গ্রামস্থ ভদ্র লোকে অনেক ব্যয় করিয়া চৌপাড়ীঘর প্রস্তুত করিয়া দিলেন এবং ছাত্রদের আহারাদির ব্যবস্থা করিয়া দিয়া তাঁহাকে অধ্যাপনায় প্রবৃত্ত করিলেন। তাঁহাদের এত করিবার উদ্দেশ্য এই যে, গ্রামে অধ্যাপক রহিলেন, ব্যবস্থার জন্য অন্য কোন স্থানে যাইতে হইবেক না। দুর্ভাগ্যবশতঃ তার কাছে ব্যবস্থা চাহিলে তিনি পুঁতি হাঁটকাইয়া হয় ব্যবস্থা করিতে পারিতেন না, নয় উল্টা ব্যবস্থা করিয়া দিতেন। গ্রামস্থ লোকে বিরক্ত হইয়া তাঁর অধ্যাপকের নিকটে গেলেন এবং সবিশেষ সমস্ত জানাইয়া এই অনুযোগ করিতে লাগিলেন, বিদ্যালঙ্কারকে আপনি কি পড়াইয়াছেন; তার কিছুমাত্র বিদ্যা জন্মিয়াছে এরূপ বোধ হয় না।
এই অনুযোগ শুনিয়া অধ্যাপক ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, ‘মনে কর, তোমরা অন্ধকার ভাঁড়ারে তাড়াতাড়ি নানা দ্রব্যসামগ্রী আনিয়া ফেলিয়াছ; আলো দেওয়া হয় নাই ও যে স্থানে যে দ্রব্য রাখা উচিৎ সে ব্যবস্থা করা হয় নাই; এ অবস্থায় কোনও একটা দ্রব্য শীঘ্র বাহির করিয়া আনিতে বলিলে হয় তোমরা তৎক্ষনাৎ তাহা দিতে পারিবা না, নয় একটা উল্টা দ্রব্য আনিয়া দিবে। সেইরূপ বিদ্যালঙ্কারও, তাড়াতাড়ি অনেক বিদ্যা পেটে পুরিয়া লইয়া গিয়াছেন, এখনও সব সাজান হয় নাই। যতদিন সাজান না হইতেছে, ততদিন এইরূপ হইবেক; সাজান হইলে আর কোনও গোলযোগ থাকিবেক না’।
চতুর্থ গল্প
========
এক বড়মানুষের কতকগুলি উমেদার ছিলেন। আহার প্রস্তুত হইলে বাবু পার্শ্ববর্তী গৃহে গিয়া আহার করিতে বসিলেন; উমেদারেরাও সঙ্গে সঙ্গে তথায় গিয়া বাবুর আহার দেখিতে লাগিলেন। নতুন পটল উঠিয়াছে; পটল দিয়া মাছের ঝোল করিয়াছে। বাবু দুই-চারিখান পটল খাইয়া বলিলেন, পটল অতি জঘন্য তরকারি; ঝোলে দিয়া ঝোলটাই খারাপ করিয়াছে। ইহা শুনিয়া উমেদারেরা বিষ্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, কি অন্যায়। আপনার ঝোলে পটল!! পটল তো ভদ্রলোকের খাদ্য নয়; কিন্তু ঝোলে যতগুলি পটল ছিল বাবু ক্রমে ক্রমে সকলগুলিই খাইলেন এবং বলিলেন, দেখ পটলটা তরকারি বড় মন্দ নয়। তখন উমেদারেরা কহিলেন, পটল তরকারির রাজা; পোড়ান, ভাজুন, সুক্তায় দ্যান, ডালনায় দ্যান, চড়চড়িতে দ্যান, ঝোলে দ্যান, ছোকায় দ্যান, দম করুন, কালিয়া করুন, সকলেই উপাদেয় হয়; বলিতে কি, এমন উৎকৃষ্ট তরকারি আর নাই। বাবু কহিলেন, তোমরা তো বেশ লোক; যেই আমি বলিলাম, পটল ভাল তরকারি নয়, অমনি তোমরা পটলকে নরকে দিলে। যেই আমি বলিলাম, পটল বড় মন্দ তরকারি নয়, অমনি তোমরা পটলকে স্বর্গে তুলিলে। উমেদারেরা কহিলেন, মহাশয়, আপনি অন্যায় আজ্ঞা করিতেছেন; আমরা ঝোলেরও উমেদার নই, পটলেরও উমেদার নই; উমেদার আপনার; আপনি যাহাতে খুসি থাকেন, তাহাই আমাদের সর্বপ্রযত্নে কর্তব্য। এই উত্তর শুনিয়া বাবু নিরুত্তর রহিলেন।
পঞ্চম গল্প
=========
যদি বলেন, নরক কেমন সুখের স্থান, সে বোধ থাকিলে তুমি কখনই নরকে যাইতে চাহিতে না। এ বিষয়ে বক্তব্য এই, কিছুদিন পূর্বে কলিকাতায় এক ভদ্র-সন্তান বেয়ারা ইয়ার হইয়াছিলেন। তিনি একবারে উচ্ছন্ন যাইতেছেন ভাবিয়া তাঁহার গুরুদেব উপদেশ দিয়া তাঁহাকে দুরস্ত করিবার চেষ্টা পাইয়াছিলেন। ‘তোমার কি নরকে যাইবার ভয় নাই’, গুরুদেব এই কথা বলিলে সেই সুবোধ, সুশীল, বিনয়ী ভদ্রসন্তান কহিয়াছিলেন, ‘আপনি দেখুন, যত প্রবলপ্রতাপ রাজা রাজঢ়া, সব নরকে যাইবেন; যত ধনে মানে পূর্ণ বড় লোক, সব নরকে যাইবেন; যত দিলদরিয়া তুখড় ইয়ার, সব নরকে যাইবেন; যত মৃদুভাষিনী চারুহাসিনী বারবিলাসিনী, সব নরকে যাইবেন; স্বর্গে যাইবার মধ্যে, কেবল আপনাদের মত টিকিকাটা বিদ্যাবাগীশের পাল। সুতরাং, অতঃপর নরকই গুল্জার; এবং নরকে যাওয়াই সর্বাংশে বাঞ্ছনীয়’। আমারও সেই উত্তর।
উদ্ধৃতি ১
========
দেখুন, বাটীতে বিধবা থাকিলে, গৃহস্থের কতমত উপকার হয়। প্রথমত, মিনি মাইনায় রাধুনী চাকরানি, মেথরানি পাওয়া যায়; দ্বিতীয়ত, সময় সময় বাটীর পুরুষদিগের প্রকারান্তরে অনেক উপকার দর্শে। তৃতীয়ত, বাটীর চাকরেরা বিলক্ষণ বশীভূত থাকে, ছাড়াইয়া দিলেও হতভাগার ব্যাটারা নড়িতে চায় না। চতুর্থত, প্রতিবাসীরা অসময়ে বাটীতে আইসেন।
উদ্ধৃতি ২
========
ব্যভিচার যদি দোষ বলিয়া গণ্য হইত তাহা হইলে এই পবিত্র দেশের অতপবিত্র সাধুসমাজে কদাচ এরূপ প্রবলভাবে প্রচলিত থাকিত না। পুরুষের ব্যভিচার, এদেশে দোষ বলিয়া কখনও উল্লিখিত হইতে শুনি নাই; কেবল স্ত্রীলোকের বেলায় দোষ বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে।
উদ্ধৃতি ৩
=========
ভ্রুণহত্যাকে পাপজনক বা কোন অংশে নিন্দনীয় বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারেন, কই, এমন ব্যাটাছেলে তো এ পর্যন্ত আমার দিব্যচক্ষে ঠেকে নাই। পেট ফাঁপিলে ও পেটে মল জমিলে ডাক্তারেরা জোলাপ দিয়া পেট পরিস্কার করিয়া দেন। ভ্রুণহত্যাও পবিত্র সাধুসমাজের প্রাতঃস্মরণীয় চাঁই মহোদয়দিগের ন্যায়, স্থির চিত্তে বুঝিয়া দেখিলে তাহার অতিরিক্ত কিছুই নয়।
(আজ তাঁর জন্মদিনে আমার সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি)