Skip to main content
বিদ্যাসাগরের কয়েকটি তীর্যক গল্প ও উদ্ধৃতি - প্রথম পর্ব

        হৃদয়ের সাড়া এলে আর শাস্ত্রের দোহাই লাগে না। সে ঠিক, কিন্তু সে নিজের কাছে লাগে না, কিন্তু সমাজের কাছে? যে সমাজ দেশাচারের অন্ধশৃঙ্খলে মানুষকে মানুষ পর্যন্ত জ্ঞান করতে ভুলেছে? তার বেলা? তখন ঝুড়ি ঝুড়ি প্রমাণ জোগাড় করতে হয়, বলতে হয়, তোমরা যা করছ তা ভুল, তা বর্বরোচিত, এখনই বন্ধ করো, নইলে সভ্যতার ইতিহাসে মুখ দেখানোর যোগ্য থাকবে না। বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ, ভ্রুণহত্যা - এগুলোর বিরুদ্ধে যে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি কোনো নারী ছিলেন না, কিন্তু সে সময়ে দাঁড়িয়ে যিনি নারীদের দুর্দশায় শুধু চীৎকার করেননি, দিনে রাতে রাস্তায় গৃহে দু’চোখের জলে ভেসেছিলেন তিনি একজন পুরুষ। হয়ত এই দুটো শব্দই অসম্পূর্ণ বললাম, তিনি একজন পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। কি অমানুষী পরিশ্রম করেছিলেন তার সেই দুটো গ্রন্থে, এক ‘বিধবাবিবাহ’ (দুটো সংস্করণ) আর ‘বহুবিবাহ’ পড়লেই বোঝা যায়। সেই বইগুলো নিয়ে সারা বাংলায় তুমুল ঝড়, ব্যক্তিগত আক্রমণ, অপমানের তো বন্যা বয়ে যাচ্ছেই, আর এ মানুষটা একটার পর একটা যুক্তি তার অগাধ শাস্ত্রীয়জ্ঞান দিয়ে ছিন্ন করে চলেছেন। সেই নরপশুতুল্য মানুষগুলোর শাস্ত্রীয় যুক্তির শুধু ভুল ধরিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, ছদ্মনামে ব্যঙ্গাত্মক পলেমিক (অতি অল্প হইল, আবার অতি অল্প হইল, ব্রজবিলাস ইত্যাদি) লিখছেন। সেখানে নিজেকে নিয়ে নিজেই ঠাট্টা করছেন, 'ভাইপো' ছদ্মনামে, তার সাথে সামাজিক দ্বিচারিতা, ভণ্ডামী, মুখোশধারী শুভ উপদেষ্টাদের স্বরূপ উন্মোচন করে চলেছেন। 
        আমার ক্ষমতা নেই সেই শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার আলোচনা করার, আর তার এই সময়ে দাঁড়িয়ে হয়ত সেরকম প্রয়োজনও নেই। কিন্তু সেখানে কিছু সরস গভীর গল্পের উল্লেখ আছে। মানুষটার রসিকতা করার ক্ষমতা ছিল তুখোড়, সে কথা অনেকেই ওনার সম্বন্ধীয় স্মৃতিকথায় লিখেছেন। সেই রকম কিছু গল্প আর কয়েকটা উদ্ধৃতি আজ আর কাল দেওয়ার ইচ্ছা রইল। 
        আগামীকাল তাঁর জন্মদিন, এই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।


         প্রথম গল্প
   =========
        কিছুকাল পূর্বে, এই পরম পবিত্র গৌড়দেশে কৃষ্ণহরি শিরোমণি নামে এক সুপণ্ডিত অতি প্রসিদ্ধ কথক আবির্ভূত হইয়াছিলেন। যাঁহারা তাহার কথা শুনিতেন, সকলেই মোহিত হইতেন। এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী, প্রত্যহ তাঁহার কথা শুনিতে যাইতেন। কথা শুনিয়া, এত মোহিত হইয়াছিলেন যে তিনি অবাধে সন্ধ্যার পর তাঁহার বাসায় গিয়া তদীয় পরিচর্যায় নিযুক্ত থাকিতেন। ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়া অবশেষে ওই বিধবা রমণী গুণমণি শিরোমণি মহাশয়ের প্রকৃত সেবাদাসী হইয়া পড়িলেন। 
        একদিন, শিরোমণি মহাশয় ব্যাসাসনে আসীন হইয়া স্ত্রীজাতির ব্যভিচার বিষয়ে অশেষবিধ দোষ কীর্তন করিয়া, পরিশেষে কহিয়াছিলেন, ‘যে নারী পরপুরুষে উপগতা হয়, নরকে গিয়া তাহাকে অনন্তকাল যৎপরোনাস্তি শাস্তিভোগ করিতে হয়। নরকে এক লৌহময় শাল্মলি (সিমূল) বৃক্ষ আছে। তাহার স্কন্ধদেশ অতি তীক্ষ্মাগ্র দীর্ঘ কণ্টকে পরিপূর্ণ। যমদূতেরা ব্যভিচারিণীকে সেই ভয়ংকর শাল্মলি বৃক্ষের নিকটে লইয়া গিয়া বলে, তুমি জীবদ্দশায় প্রাণাধিকপ্রিয় উপপতিকে নিরতিশয় প্রেমভরে যেরূপ গাঢ় আলিঙ্গন করিতে, এক্ষণে এই শাল্মলি বৃক্ষকে উপপতি ভাবিয়া সেইরূপ গাঢ় আলিঙ্গন দান করো। সে ভয়ে অগ্রসর হইতে না পারিলে যমদূতেরা যথাবিহিত প্রহার ও যথোচিত তিরস্কার করিয়া, বলপূর্বক তাহাকে আলিঙ্গন করায়। তাহার সর্ব শরীর ক্ষত বিক্ষত হইয়া যায়। অবিশ্রান্ত শোণিতস্রাব হইতে থাকে। সে যাতনায় অস্থির ও মৃতপ্রায় হইয়া অতিকরুণ স্বরে বিলাপ, পরিতাপ ও অনুতাপ করিতে থাকে। এই সমস্ত অনুধাবন করিয়া, কোনো স্ত্রীলোকেরই অকিঞ্চিৎকর, ক্ষণিক সুখের অভিলাষে, পরপুরুষে উপগতা হওয়া উচিত নহে।‘ ইত্যাদি। 
        ব্যভিচারিণীর ভয়ানক শাস্তিভোগবৃত্তান্ত শ্রবণে কথকচূড়ামণি শিরোমণি মহাশয়ের সেবাদাসী ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, ‘যাহা করিয়াছি, তাহার আর চারা নাই, অতঃপর, আর আমি প্রাণান্তেও পরপুরুষে উপগতা হইব না।‘ সেদিন সন্ধ্যার পর তিনি পূর্ববৎ শিরোমণি মহাশয়ের আবাসে উপস্থিত হইয়া যথাবৎ আর আর পরিচর্যা করিলেন, কিন্তু অন্যান্য দিবসের মত তাঁহার চরণসেবার জন্য যথাসময়ে তদীয় শয়নগৃহে প্রবেশ করিলেন না।
        শিরোমণি মহাশয় কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিলেন, অবশেষে বিলম্ব দর্শনে অধৈর্য হইয়া তাঁহার নামগ্রহণপূর্বক বারংবার আহ্বান করিতে লাগিলেন। সেবাদাসী গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট না হইয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান রহিলেন এবং গলবস্ত্র ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, গলদশ্রু লোচনে, শোকাকুল বচনে কহিলেন, ‘প্রভো! কৃপা করিয়া আমায় ক্ষমা করুন। সিমূল গাছের উপাখ্যান শুনিয়া আমি ভয়ে মরিয়া রহিয়াছি। আপনকার চরণসেবা করিতে আর আমার কোনোও মতে প্রবৃত্তি ও সাহস হইতেছে না। না জানিয়া যাহা করিয়াছি তাহা হইতে কেমন করিয়া নিস্তার পাইব সেই ভাবনায় অস্থির হইয়াছি।’
        সেবাদাসীর কথা শুনিয়া পণ্ডিতচূড়ামণি শিরোমণি মহাশয় শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং দ্বারদেশে আসিয়া সেবাদাসীর হস্তে ধরিয়া সহাস্য মুখে কহিলেন, ‘আরে পাগলি! তুমি এই ভয়ে আজ শয্যায় যাইতেছ না? আমরা পূর্বাপর যেরূপ বলিয়া আসিতেছি আজও সেইরূপ বলিয়াছি। সিমূলগাছ পূর্বে ঐরূপ ভয়ঙ্কর ছিল যথার্থ বটে, কিন্তু শরীরে ঘর্ষণে ঘর্ষণে লৌহময় কণ্টকসকল ক্রমে ক্ষয় পাওয়াতে সিমূলগাছ তেল হইয়া গিয়াছে। এখন আলিঙ্গন করিলে সর্ব শরীর শীতল ও পুলকিত হয়’। এই বলিয়া, অভয়প্রদান ও প্রলোভন প্রদর্শনপূর্বক শয্যায় লইয়া গিয়া গুণমণি শিরোমণি মহাশয় তাঁহাকে পূর্ববৎ চরণসেবায় প্রবৃত্ত করিলেন।

Category