Skip to main content
the whale

কোন মানুষের জীবনে সব সিদ্ধান্ত ঠিক হয়? কোন মানুষের জীবনে কোনো পশ্চাতাপ নেই, ক্ষোভ নেই, এমন হয়?

কোনো দৃশ্যে মেঘ জমানো আকাশের ছবি নেই। কিন্তু প্রায় দীর্ঘ সময় জুড়ে বৃষ্টির আওয়াজ আছে। কারণ যে মানুষটাকে নিয়ে গল্প সে বহুদিন আকাশ দেখে না। অথচ এক আকাশ ভালোবাসা, বিশ্বাস আর অভিমান নিয়ে বেঁচে আছে।

সিনেমাটার প্রথম দৃশ্য একজন মধ্যবয়েসী অতি-অতি স্থূলকায় মানুষের সোফায় বসে হস্তমৈথুনের দৃশ্য। ক্যামেরার অবস্থানে বোঝা যাচ্ছে ল্যাপটপে কোনো পর্ণোগ্রাফি চলছে। হস্তমৈথুনের দৃশ্যে যন্ত্রণার ছবি। শারীরিক অতিকায়ত্বের জন্য শ্বাসের অসুবিধা, মৈথুনের আবেগের তীব্রতাকে সহ্য করতে না পারা দুমড়ে যাওয়া শরীরী অসহায়তা। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসা। এমন সময় অতর্কিতে এক যুবকের ঢুকে পড়া, সে খ্রীষ্টের বাণী প্রচার করতে এসেছে। বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। মানুষটা বাঁচার জন্য হাঁসফাঁস করছে। তার বাঁচার উপায় একটা প্রবন্ধের ক'টা লাইন।

গল্পে চরিত্র প্রকাশ্যে পাঁচজন। গোটা গল্পটাই একটা ঘরে। সময়কাল একটা গোটা সপ্তাহেরও নয়। যে সময়টুকু তার জীবনের অবশিষ্ট বেঁচে।

গল্প চলতে চলতে কত ছোটো ছোটো শাখা তৈরি হয়েছে। আমি কয়েকটা শাখায় আলোচনাটা করি, আমার মতো করে।

 

র্ম

====

বিশ্বাস ছাড়া মানুষ বাঁচে না। জীবন থাকে না। এত বড় জীবনের মুখোমুখি সে হয় শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোরে। যেমন নৌকা বাইতে গেলে দাঁড়, হাল, পাল, সব সহায়ক হয়, কিন্তু মাঝির বিশ্বাস যদি না থাকে সে পারবে, তবে নৌকা এগোতে পারে না, তেমনই মানুষের জীবনের কেন্দ্রে জাগে বিশ্বাস।

সমস্যা হয় সে বিশ্বাস যখন প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়ায়। তখন সে অন্তরের শুভ অশুভের বিবেচনা ছেড়ে বাইরের প্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্রের ছাপা অক্ষর হতে চায়। প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির স্বতন্ত্রতাকে নষ্ট না করলে নিজেকে দাঁড় করাতে পারে না। যে মানুষের কাছে নিজের স্বতন্ত্রতা বিড়ম্বনা তার কাছে তাই একটা প্রতিষ্ঠান বাঁচার একমাত্র আশা। যে মানুষ গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিলেই ধাক্কা লাগায়, সে মাইনে করা ড্রাইভারের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। আর যে মানুষের কাছে নিজের স্বতন্ত্রতা গৌরবের, তার কাছে প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র বিড়ম্ভনা। সে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে পেলেই নিজেকে মুক্ত মনে করে, স্টিয়ারিংকে সে একটা আস্ত আপদ হিসাবে দেখে না।

প্রত্যেক মহাপুরুষ তাই আমাদের স্টিয়ারিং হাতে ধরতে বলে। তার চেলারা বলে, ও আপনার দ্বারা হবে না, আপনি পিছনের সিটে চোখ বন্ধ করে আরাম করে বসুন, আমরা দেখে নিচ্ছি, আমাদের উনি বিশেষ ক্ষমতায় ভূষিত করে গেছেন। দুর্বল প্রাণ এই সব শুনে কৃতজ্ঞতায় বর্তে যায়, সবল প্রাণ গর্জে ওঠে।

গল্পের মানুষটা শুধু ভালোবাসায় বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু যাকে সে ভালোবেসেছিল সে অতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল না, আবার সম্পূর্ণ দুর্বলও ছিল না। নিজের প্রাণের বোধের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বোধের মধ্যে একটা সামঞ্জস্যের চেষ্টা হয় তো করেছিল, পারেনি। নিজেকে শেষ করে দিয়েছিল। সে অভিমানে নিজেকে আবদ্ধ করে নিল গল্পের মানুষটা - চার্লি।

 

একাকীত্ব আর সম্পর্কেরা

=====================

দিনরাত শুধু বৃষ্টির আওয়াজ। বৃষ্টি বাইরের মানুষকে অকেজো করে, ভিতরের মানুষকে জাগিয়ে দেয়। চার্লি অনলাইনে ইংরাজি সাহিত্য পড়ায়। বাকি সময়টুকু তাকে দেখাশোনা করতে মাঝে মাঝে আসে একজন নার্স। বন্ধুত্বের সম্পর্ক দু'জনের। বাকি সময়টুকু চার্লি একা। দরজার বাইরে খাবার রেখে, বাইরে রাখা পয়সা নিয়ে প্রতিদিন ডেলিভারি বয় চলে যায়। তার চলে যাওয়ার ছায়া দেখে চার্লি। খায়। শুতে যায়। স্নান করে। প্রতিটা কাজ করতে তাকে সাপোর্ট নিতে হয়, ওয়াকার, নইলে হুইলচেয়ার। বিছানার উপর হাতল, বাথরুমে হাতল। নিজের শরীরটাকে এক বিন্দু নাড়ানো একটা চ্যালেঞ্জ।

ভালোবাসা মানুষটাকে কেড়েছে তার ধর্মের ভয়। সমাজের ভয়। ক'দিন আগে আমাদের দেশে বলা হল সমলিঙ্গের মানুষদের মধ্যে বিয়ে হলে “ভারতীয় সমাজ” ব্যবস্থার সঙ্গে তা ঠিক মিশ খাবে না। হয় তো ক্ষতিই হবে।

ভয়ের কারণ অবশ্যই একটা বিশেষ ধরণের বিশ্বাস। আবার সেই প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস। সমাজ যখন একটা অচলায়তন হয়ে ওঠে, তখন অনেক ধরণের বিশ্বাস জন্মায়। যে সমাজ যত পুরোনো সে সমাজে তত নানা ধরণের স্থান মাহাত্ম্য। পুরোনো বটগাছ, পুরোনো মন্দির, পুরোনো পুঁথি, পুরোনো আচার-বিচার ইত্যাদি ইত্যাদি। সেগুলো ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেগুলো পুরোনো বলেই পবিত্র, এই যুক্তিটা সব পুরোনো সমাজে আছে। বাবুইপাখি আজও যুগান্তরের নিয়মে বাসা বাঁধে, সেই জন্যেই যদি তার কাজটা পবিত্র হয়ে ওঠে, তবে সে অযৌক্তিক শুধু না, অপযুক্তির কথা। কিন্ত সমাজ যুক্তিতে চলে না, সংখ্যাতত্ত্বে চলে। তাই মাঝে মাঝেই এক সঙ্গে সবাই মিলে দিনের আলোকে রাত আর রাতের অন্ধকারকে আলো বলে চীৎকার করে ওঠে, যাকে সাংস্কৃতিক উদযাপন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

চার্লি কোনো ধার করা বিশ্বাসের অনুগামী নয়। এমনকি হাস্পাতালেও যেতে চায় না। সব সে রাখতে চায়, জমিয়ে রাখতে চায়, তার নিজের জন্যে নয়, তার আগের পক্ষের মেয়ের জন্য। তার একমাত্র সন্তানের জন্য। যাকে সে দূর থেকে বড় করতে চায়। মানুষ করতে চায়। সামাজিক সব অপবিজ্ঞানের বাইরে রাখতে চায়। শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে চায়। তার সমস্ত যা কিছু দুষ্টুমিকে সে বাঁধন ছেঁড়ার বিদ্রোহ হিসাবে দেখে। তার আপাত রুক্ষ হয়ে যাওয়া, কাঠিন্যকে সে আত্মশক্তির প্রকাশ হিসাবে দেখে। তার জানলার বাইরে রাখা কাঁচের পাত্র, সেখানে চার্লি কাটা ফল রাখে, পাখির জন্য, কারণ চার্লি মুক্ত উড়াল ভালোবাসে। ঘরের মধ্যে আগল দিয়ে কোনো পাখি পোষেনি তাই, বাইরে রেখেছে। মেয়ের খামখেয়ালিপনাকে সে আমল দেয় না, কিন্তু মেয়ের বোধের তীক্ষ্মতার ধারভার পরীক্ষা করে দেখে, কারণ তার হাতে সময় কম।

একাকীত্বর পরিধির বাইরে যারা, তার প্রাক্তন স্ত্রী, তার মেয়ে, তার নার্স, যীশুর বাণীর আড়ালে বাঁচতে চাওয়া সে ছেলেটা… কারুর উপর সে রুক্ষ নয়, ক্ষুব্ধ নয়। তাদের সবার কাছ থেকে একটা জিনিসই চায়, অনেস্টি। সততা, নিজের বোধের সঙ্গে, নিজের ভালোবাসার সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকেও শেষ সেই দাবী তার, জীবনে সব চাইতে বড় প্রয়োজন সততার। নিজের মুখোমুখি বাঁচার ক্ষমতা যে অর্জন করেছে, যে নিজেকে স্বচ্ছ স্পষ্ট হিসাবে পেয়েছে, আসলে সে সব পেয়েছে।

 

আলো

======

স্বচ্ছতা মানে যে আলোকে নিজের মধ্যে আসার রাস্তা করে দেয়। যখন সব স্বচ্ছ হয়, মানুষ বোঝে মানুষের মধ্যে এক আগাম প্রতিষ্ঠিত অনুকম্পা আছে। “মানুষ মানুষের উপর সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতে অক্ষম” - এ সত্য গভীরতম সত্য, এর বিপরীতে অজস্র উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও এ সত্য। আর একেই আমরা সত্যি বলে জানি বলে এত এত কাঠিন্যের মধ্যেও আমরা বেঁচে থাকার বিশ্বাসকে হারিয়ে ফেলিনি। জীবনের উপর প্রাথমিক বিশ্বাসটুকু এই, তবু ভালোবাসা আছে। ভালোবাসাই আছে। এর বাইরে এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা বিষাদকে উপনিষদের ব্রহ্মের মত স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে, অতীতে ভবিষ্যতে দেখে বই লিখে, কবিতা লিখে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড উদ্ধার করে দিচ্ছে। যেন নতুন কোনো সত্যকে আবিষ্কার করেছে। নিজের ভিতরে ডিসর্ডার থাকলে গোটা বিশ্বে কেবল ডিসর্ডারই দেখে। বুদ্ধির জ্ঞান আহরণে ত্রুটি নেই, কিন্তু বোধের নিজের মধ্যে স্থৈর্য নেই, নিজের মধ্যে ডুবে নিজেকে খোঁজার। রুমি বলতেন নিজে দশপাক ঘুরে নিলে গোটা বিশ্ব বনবন করে ঘোরে। সবের মধ্যে এক সামঞ্জস্য আছে। সে সামঞ্জস্যের বোধেই আনন্দ। আলো।

সব শেষে বলি অভিনয়। ব্রেন্ডান ফ্রেজার এ বছর শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেলেন অস্কারে। মেক আপেও অস্কার জিতেছে সিনেমাটা। আমি এতটুকুই বলি সিনেমাটা দেখার পর থেকে আমি অন্তত আর কোনো সিনেমায় মন দিতে পারছি না। একজন মানুষ দীর্ঘদিন আলোকবৃত্তের বাইরে থেকে আবার এভাবে ফিরে আসে, তা বিস্ময়ের। যে অভিনয় উনি করেছেন যতদিন সিনেমা বলে কিছু থাকবে, ততদিন মানুষ স্মরণ করবে। বিস্মিত হবে। রোমাঞ্চিত হবে।

আপাতত স্ট্রিমিং হচ্ছে সোনি লিভ এ।