অনুভবের অনেক নাম আছে। একটা নাম - ইচ্ছা। ইচ্ছা, আমার অনুভব। যদি সব কোলাহল থেকে সরে আসো, যদি নিজের মধ্যে ডুবে দেখো, দেখবে অবাস্তব থেকে বাস্তবের দিকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে যা নামছে, সে অনুভবের নাম, ইচ্ছা। সে অন্ধকার থেকে রূপ নিচ্ছে। সে নিজেকে জন্ম দিচ্ছে। ইচ্ছা।
প্রতিক্রিয়া মানে ইচ্ছা না। প্রতিক্রিয়ায় থাকে হিংসা, ঈর্ষা, লোভ। সে বাইরের। ধরো ভীষণ পিছল রাস্তা, প্রচুর শ্যাওলা। তুমি প্রথম পা দিতেই পা পিছলে যেতে চাইল। তুমি কি দেবে নিজেকে পিছলে যেতে? নাকি পায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে, শরীরের সাম্যে থাকার সমস্ত বল দিয়ে নিজেকে আটকাবে?
প্রতিক্রিয়ার অনুভবও তাই। সে এলো বলেই তার কাছে হাল ছাড়ার কোনো কারণ নেই। তাকে উপেক্ষা করলে সে আপনি মিলিয়ে যায়। সব শান্ত হলে আবার মনের মধ্যে প্রাচীন অনুভব, বিন্দু বিন্দু জন্মাচ্ছে, সে ইচ্ছা।
কিছু মানুষ জন্মায় যারা জীবন শিল্পী। তারা গান গাইবে, ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে - এ সব নিয়ে যে ব্যস্ত থাকবে, তা নয়। তারা খালি খালি এই ইচ্ছাটার দিকে তাকাবে, আর জিজ্ঞাসা করবে, হ্যাঁ গো, এই যে খাঁটি জিনিস, একে নিয়ে কি করবে? এতো রত্ন। এ আছে বলেই তুমি আছো, এ রত্নপেটিকা যেদিন ফুরিয়ে যাবে, সেদিন তুমি থেকেও নেই। কি করবে এ দিয়ে?
যদি আমি বলি, একে নিয়ে আমি হাটে যাব। এটা, ওটা সেটা কিনে ঘরে আনব। অনেক জমাবো।
সে তখন বলবে, সেও হয়, কিন্তু আরেক দিকেও নিয়ে যেতে পারো, তবে এ রত্নপেটিকা হবে না শূন্য কোনোদিন।
আমি জিজ্ঞাসা করি যদি কি সে?
সে বলবে, যেদিকে শুভ, মঙ্গল, ভালো। যা কিছু ভালো তার হাতে যদি তুলে দাও এ রত্নভান্ডার, তবে ফিরে পাবে আরো। দেবে কি?
কি ভালো? যদি জিজ্ঞাসা করো।
সে বলবে, সে তোমায় খুঁজে নিতে হবে। ভালোর কোনো সংজ্ঞা হয় না। ভালো, ইচ্ছার গভীরে জাগা তৃষ্ণা। যদি ভালোকে নাম দাও, তবে সে শৃঙ্খল, যদি ভালোকে খুঁজে বেড়াও, তবে সে সাধনা। তবে সে জীবন্ত।
বর্তমানে বিজ্ঞান আমাদের সীমা আর অসীম - এ দুয়েরই তত্ত্ব দিচ্ছে। স্টিভেন পিনকারের এই 'ব্ল্যাঙ্ক স্লেট' বইও নানা বিতর্ক তৈরি করেছে। কিন্তু ইচ্ছা কি শর্তাধীন? পিনকার বলছেন, না। ইচ্ছার সবটুকু শর্তাধীন নয়। মানুষের জীবন চয়েস শূন্য নয়। সে এক এদিক-ওদিক না যেতে পারা আবর্তে পিষে পিষে চলছে, তা আদৌ নয়। মানুষের মন রামকৃষ্ণদেব বলছেন, ধোপাঘরের কাপড়, যে রঙে ছোপাবে, সে রঙই ধরবে। পিনকারও বলছেন, তোমার মেধা, তোমার বিচক্ষণতার সঙ্গে তোমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জিনের সংকেতের খুব একটা কিছু করার নেই। তোমার পরিবেশ, তোমার বড় হওয়া - এ সবের অনেক বড় ভূমিকা নিশ্চয়ই রয়েছে।
ইচ্ছা, এক অনুভব। যে অনুভবের সঙ্গে 'আমি' মিশে। এক 'আমি' এই অনুভব, এই ইচ্ছা, আরেক 'আমি' বিচারক, সে দেখছে, সে সম্মতি দেবে কি দেবে না ভাবছে। এ সবের বাইরে আরেক উদাস 'আমি', যে হ্যাঁ-না কিছুই বলে না। যে রঙ্গ দেখে। পিনকার মানুষের গভীর সত্তার কাছে প্রশ্ন নিয়ে যায়। উত্তর আসে, দিশা হয়ে, তত্ত্ব হয়ে না। পিনকার বলে অনেক রাস্তা হাঁটার বাকি আরো। রাসেল বলে, জানি, অবশেষে চাই মানুষ প্রজ্ঞাবান হোক, শান্তি আর ভালোবাসাকে খুঁজে। সত্য মানে শুধু তো তত্ত্ব না। সত্য মানে ইচ্ছার সত্যও আছে। সে কেবল সংহতির দিকেই। নইলে ক্ষুদ্রতায় কোনো সার্থকতা নেই। রবীন্দ্রনাথ সীমার মাঝে যে অসীমের সুর শুনেছেন, সেও একই কথা বলে। কোথাও বাঁধা আছি বলেই সে সব কথাটুকু না, কোথাও ছাড়াও আছি। সে কথা ভুললে, নিজেকে অপমান করা হয়।