সে ভালোবাসা জাগলে পাঁচিল ভাঙে। সংসার ভেসে যায়। এদিকটা আমার, এরা আমার, ওদিকটা তোমার, ওরা তোমার… বলার লোক কই? গুটি কেটে প্রজাপতি উড়ে গেছে…. ওই….
শেওড়াফুলি ট্রেন ঢুকল। শীতের আবেশে ঘুম কাটছে না। চাদরে, মাফলারে জড়িয়ে-মড়িয়ে বন্ধ চোখ এদিক ওদিক। ভিড় বেশি নেই।
চা খাওয়াবা?
সংসার ছাড়লে কেন?
খাটের থেকে পাখা, মাঝে মানুষটা, ঝুলছে, খাটের থেকে পা এই চার আঙুল ফাঁক…. তাকান… এই… এই চার আঙুল…..
কি হয়েছিল?
জায়ের সঙ্গে ঝগড়া…. বিধবা ছিল বৌদি…. এটা-ওটা নিয়ে লেগেই থাকত….ও বলত বৌদি ওকে মন্ত্র পড়ে বাঁজা করেছে….
শোকে ছাড়লে….. ওটি কে?
তারা…. ওরও কেউ নেই…. ছেলে খেদিয়েছে…..
তাই গেরুয়া…..
পেট…. বড় বালাই… মনে দেওয়াল নেই…দেওয়াল তুলি সে ইচ্ছাও নাই… তারা আর আমি ভাসতে ভাসতে পাশে এলাম… বাবার ইচ্ছাই হবে…. লীলা…. চললাম…. বাঁধাবাঁধি নেই….
এও কি ভালোবাসা?
হ্যাঁ গো…. শোকের বুকে এক ভালোবাসা জন্মায়…শোক পিচুটি কাটায়… সংসার বিবাদ, দ্বন্দ্ব আর বিষাদের ছই দেওয়া…. ছায়া হয়ে থাকে… আলো নেই…. এই ভালোবাসা আলো না হলে জন্মায় না….
======
স্টেশানে ট্রেন ঢুকল। তারকেশ্বর। নামতেই ধুতি পরা কয়েকজন এগিয়ে এলো। আসুন আসুন… বাড়ি আছে… ঘর আছে… সব রেখে মন্দিরে যাবেন… পুজো দিয়ে নিয়ে আসব…. ঘরের ভাড়া লাগবে না….
আমাকে কাউকে বাছতে হল না। একজন নিজেই বেছে নিল। বলল, আসুন। কোঁকড়া চুল। বয়েস তিরিশের ঘরে। রোগা ছিপছিপে শরীর। আসুন…, বলে সেই যে হাঁটা লাগালো আর পিছনে তাকানো নয়…. চলছে আর চলছে…. গলি রাস্তা দোকানপাট পেরিয়ে চলেছি। ধর্মস্থান। তীর্থ। ইতিহাস জিজ্ঞাসা করো কেন? সব তো জীবন্ত। রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘরদোর, ল্যাম্পপোস্ট, খেলার মাঠ --- সব জীবন্ত।
কত টাকার পুজো দেবেন?
পুজো তো দেব না। জুতো রাখব। মন্দিরে যাব।
ও… আসুন তবে… কিন্তু বাবার জায়গা…. কিছু তো দিতে হয়… বাড়ির লোকের কল্যাণের জন্য…
কেউ নেই…. চলুন….
দাঁড়ান আর কয়েকটা পার্টি আসুক।
বসলাম। সামনে কয়েকটা কুকুর। দোকানে দোকানে ভিড় জমছে। জুতো রাখছে। ডালা বাছা হচ্ছে। একুশ… একান্ন… একশো এক…. পাঁচশো এক…. চুল দেবেন?.... তবে তো আটশো…..
দরদাম হল। জনা দশেক মানুষ। অবাঙালি। আমি এলেবেলে।
আসুন দুধপুকুরে….
জলে নামুন। কেউ মোজা খুলছে। কেউ জুতো। কেউ পায়ের প্যাণ্ট গোটাচ্ছে।
আসুন…. লাইন করে আসুন…
জলে জলে পিচ্ছিল রাস্তা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। অবাঙালি দলের লোকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বাচ্চার মানতের জন্য এসেছে সব। দাদু-দিদা, ঠাকুমা-ঠাকুর্দা, মা-বাবা, খুব সম্ভবত মাসি-মেসো। বাচ্চাটা বাবার কোলে।
আসুন আসুন…. সামনেই স্নানের জায়গা….
সোজা গিয়ে বাঁদিকে স্নানের ঘাট। পাণ্ডা ছেলেটা বলল, নিন নিন… স্নান করে নিন… তাড়াতাড়ি... একটু পর আরতি… তারপর পুজো…. মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে…. তাড়াতাড়ি…
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি তো স্নান করবেন না…. যান মন্দিরের দিকে যান…. প্রণামী যা দেবেন আমার হাতে দেবেন…. নাম কি? সেকি! ব্রাহ্মণ তো…. গোত্র?
======
মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কাশীর বিশ্বেশ্বর, নাসিকের ত্র্যম্বকেশ্বর, দেওঘরের বৈদ্যনাথধাম যাওয়া হয়েছে। বাড়ির কাছেই আসা হয় না। ভিড় করে সামনে দাঁড়াচ্ছে ভক্তেরা। বেশিরভাগ মানুষই এই ঠাণ্ডায় স্নান করে ভিজে কাপড়ে। কাশীতে যেমন "হর হর মহাদেব" বলে মাঝে মাঝেই হুঙ্কার দেওয়া হয়, এখানে তেমন কিছু কানে আসছে না। পূজারি আরতির সরঞ্জাম সাজাচ্ছেন। আমার পিছনের দিকে নাটমন্দির মনে হল। সেখানে শিঙ্গা, ঢাক, কাঁসর, ডম্বরু নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কয়েকজন। কয়েকজন পূজারি মন্দিরের সামনে রক্ষীর মত দাঁড়িয়ে। তাদের হাতেই কেউ কেউ প্রণামী দিচ্ছেন। তারা মন্দিরের ভিতরে গিয়ে পুজো দিয়ে ফুল নিয়ে বাইরে আসছেন, হাতে দিচ্ছেন, চোখের বন্ধ পাতার উপরে, কপালে জলে ভেজা আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, প্রণামী দাও... এটা পুজোর পারিশ্রমিক। কেউ কেউ মালা হাতে ঘুরছেন। মালা পরাও বাবাকে। এই নাও। হাত পেতে মালা নাও। পুরোহিতকে দাও, উনিই পরিয়ে দেবেন।
=======
আরতি শুরু হল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক সাধু এসে দাঁড়ালো সামনে। সারা গা ছাই মাখা। এত এত মানুষ কারুর দিকে তাকালেন না। তাকালেন মন্দিরের গর্ভগৃহে। আমার পিছনে, নাটমন্দির থেকে ঢাক কাসর শিঙ্গা ডম্বরু বাজছে। মন্দিরের সামনে ঘন্টা বাজাচ্ছেন দু'জন পূজারী।
ভাব কি? আবেগের এক তুঙ্গ অবস্থা। ভীষণ একাগ্র। চোখে জল আসে। মনের সব স্থূল অনুভব সে আবেগে, চোখের জলে কিছুক্ষণের জন্য নিস্তেজ। যেন কোনো দুঃখ নেই, শোক নেই, ক্ষোভ নেই। সব পরিপূর্ণ আনন্দময়। সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার সেই ট্রেনের সহযাত্রী দু'জন। চোখ বন্ধ। দু'জনের চোখেই জল। 'সংসার-দুঃখগহন জগদীশ রক্ষ।' আর্তি। আকুলতা। রক্ষা করো… রক্ষা করো….। কি আশ্চর্য, একই ধর্মের দর্শন বলছে, রক্ষা করার কিচ্ছু নেই.. তুমিই সেই অজেয়, অমর, অদাহ্য, অবধ্য সনাতন আত্মা। ভয় কিসের? আবার সেই ধর্মেই সেই দর্শনের গাতা শঙ্করাচার্য গাইছেন 'ভজ গোবিন্দম…"... ব্যাকরণ তোমায় রক্ষা করবে নাগতিস্ত্বং গতিস্ত্বং ত্বমেকা ভবানি।।'…. জগদীশ রক্ষ…. মহাপ্রভু দু'হাত আকাশে তুলে নীলাচলের তীরে ছুটছেন…. রাম রাঘব, রাম রাঘব, রাম রাঘব রক্ষমাং….. রক্ষা করো..
কিসের থেকে রক্ষা? মৃত্যু? না। পাপের থেকে রক্ষা করো। দুঃখের থেকে রক্ষা করো। দুর্গতি থেকে রক্ষা করো। যুক্তি নির্ভুল নয়। আবেগ নির্ভুল নয়। অনুভব নির্ভুল নয়। বিশ্বাস নির্ভুল নয়। বোধ নির্ভুল নয়। কিচ্ছু ধ্রুব নয়। সব সরে সরে যাচ্ছে। আমার ক্ষমতা কতটুকু? ওগো জগদীশ্বর… তুমি তরিয়ে দাও…. তুমি তারকেশ্বর…. তুমি ডাকো আমায়… আমার সব ভুল…. সব সব সব…. আমায় এত এত ভুলের থেকে রক্ষা করো…. আমায় অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে যাও…. কি সত্য? যে সত্য তুমি। যে সত্যে আমি ঢেউ, তুমি সাগর। যে সত্যে আমি খণ্ডকাল, তুমি মহাকাল। যে সত্যে আমি চঞ্চল, অধ্রুব, শোকতাপে জর্জরিত, তুমি স্থির, চিরপ্রশান্ত, আনন্দময়।
=======
আরতি শেষ। খানিকক্ষণের জন্য সব কিছু জীবন্ত হয়ে গিয়েছিল। মন্দিরের দেওয়াল, মেঝে, পাঁচিল, লোহার গারদ --- সব। সব জীবন্ত। এই ক্ষণস্থায়ী আবেগ কি সে-ই ভালোবাসা? যার কথা সহযাত্রী বলছিল। ভালোবাসায় কি সব জীবন্ত হয়? ভয়েও তো হয়। নইলে রজ্জুতে সর্পভ্রম হয় কেন?
আবেগ স্তিমিত হল। পাণ্ডার পাওনা মিটিয়ে ফিরছি। আবার মুখোমুখি হলাম সেই সহযাত্রীদের। মহিলার মাথা যতবার দেখেছি ঘোমটায় ঢাকা। এবার দেখলাম মুখটা। বলিরেখায় ভরা মুখ। দৃষ্টিতে এক উদাসীনতা। যেন গোটা জগতকে স্বেচ্ছায় প্রশ্রয় দিয়েছে তাকে দুঃখ দেওয়ার। চাইলেই সব ছেড়ে যেতে পারে। আমায় বলল, সামনেই আমাদের চটি…. দুপুরে দুটো খেয়ে যান…. ব্রাহ্মণের শরীর শুনলাম…. আমরাও প্রসাদ পাই…..
ফেরার তাড়া আছে। ইচ্ছা আছে একটু কামারপুকুর যাই। আসা তো হয় না। সময় কম। যতটা ঘুরে যাওয়া যায়।
মহিলা এমন তাকিয়ে যেন আমার এই সব উত্তরগুলো আগে থেকেই জানা ছিল। চাইলেই আমি যেতে পারি, তবু যাচ্ছি না। আমার সঙ্কোচ। কিসের সঙ্কোচ জানি না। শিক্ষা? সংস্কার? সামাজিক পার্থক্য? রুচি? যাই কারণ হোক সেটা যে উদার নয় তার জন্য বৃথা তর্ক লাগে না।
বলল, তবে আসুন…. তবে আবার যদি আসেন… ওনার নামটা বললেই হবে….
কি নাম?
পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল, সুশীলের চটি বললেই হবে…..
আচ্ছা, বলে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে ফিরেছি…. মহিলা বললেন, কিছু খেয়ে নেবেন…. বেলা হয়েছে….
চোখটা, নাকটা চড়চড় করে উঠল। গলায় কি যেন আছে। আবার ফিরে তাকালাম, হাসলাম। বললাম, বেশ, স্টেশানে খেয়ে নেব।
স্টেশানে এলাম। গোঘাট লোকাল দেরি আছে মিনিট কুড়ি। চপ আর মুড়ি কিনে এনেছিলাম। তাই নিয়ে বসলাম। আমার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন পাণ্ডা। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে। হাওড়া থেকে আসা তারকেশ্বর লোকাল ঢুকল। ভিড় নামছে। দৌড়ে গেল পাণ্ডারা। দুই সত্য। জ্ঞানও সত্য, খিদেও সত্য। অসীমও সত্য, সসীমও সত্য। একের দোরে এসে আরেক নিত্য দাঁড়ায়। অন্নপূর্ণার সামনে মহাকাল তাই আসেন ভিক্ষাপাত্র নিয়ে। এই নিয়েই জীবন। এই নিয়েই তো সবটুকু। রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় বেলের বিচি, খোল সব নিয়েই বেল। শুধু শাঁসটুকু নেব বললে হয়?