মানুষের মনোজগতের কথা থাক। তার শরীরের বৃত্তির কথা থাক। তার কল্পনা, ইচ্ছা, অনিচ্ছাও থাক। সুখ দুঃখ যাবতীয় বিষাদ ইত্যাদিও থাক।
তবে আর মানুষটার কী থাকল?
কিছুটা তো একটা থাকল। কী থাকল বলতে পারি না। কিন্তু কিছু তো একটা থাকল। আত্মা? ধুস! ওসব কথা কই বললাম আমি? কিন্তু কিছু একটা থাকল জানো। কী বলো তো?
চেতনা? ওরে বাবা! বড় হেডমাস্টারি শব্দ গো। আর কিছু নেই?
যদি বলি, তাকিয়ে থাকা!
হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই, এটাই। ভীষণ বোকা বোকা কথাটা আমি জানি। কিন্তু এ কথাটা আমার ভীষণ প্রিয়। মানে যখন আমার শরীর ভালো না, কিম্বা চলনসই হয় তো। মন কিছু একটা অবস্থায় আছে যা হোক….সুখ না দুঃখ স্পষ্ট জানি না। কোনো স্বপ্ন নেই সামনে। কিম্বা থাকলেও আছে, আমি পাত্তা দিচ্ছি না।
এই সময়ে আমি শুধু তাকিয়ে থাকি। এক এক সময় মনে হয় এর চাইতে সুখ বোধহয় আমি কিছুতে পাইনি আজ অবধি। শুধু তাকিয়ে থাকতে যে কী আরাম! আমি যখন কাউকে দেখি তাকিয়ে আছে…..এই যেমন আজকের কথাই ধরো না…আজ হঠাৎ করে বৃষ্টি এলো…তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা হবে….আমি আটকে গেলাম দোকানে….আমার থেকে কিছুটা দূরে একজন বয়স্ক ফলওয়ালাকে দেখলাম দোকানে বড় ছাতাটার নীচে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই চোখটা, শরীরের এই আলোগাছা ভাবটা আমি জানি, বেশ জানি। এই সময়টা ও শুধুই তাকিয়ে আছে। শুধুই। এই সময় দেখার চাইতে অনেক বড় কথা তাকিয়ে থাকা। চোখের দরজা দিয়ে নিজেকে বার করে বাইরে ছেড়ে দেওয়া…যা ঘুরে আয়…কিছু কুড়াস না….শুধু ঘুরে আয়….ভিক্ষা চাস না…কাড়াকাড়ি করিস না….শুধু ঘুরে আয়….
এর কোনো দর্শন হয় কিনা আমি জানি না। কী এর পিছনে মনস্তত্ব তাও জানি না। আমি শুধু জানি সব ছাপিয়ে মানুষের একটা নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা আছে। তাকে হেলায় হারাতে নেই।
সেদিন সামারসেট মমের একটা সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। তা খুড়ো বলে কি, আমি তো হাস্পাতালে দীর্ঘদিন কাজ করেছি, আমি প্রচুর মরণাপন্ন মানুষকে দেখেছি…. মুখোশহীন আসল মানুষকে দেখেছি…. বিপন্ন মানুষকে…. আমি আসল মানুষকে চিনি…..
আমি ভাবলাম মর মর মুখপোড়া। মরণাপন্ন মানুষই আসল মানুষ….কম বয়সে আমিও ভেবেছি সে কথা… কিন্তু তুমি ব্যাটা এই বুড়ো বয়সে এসে কিনা এই কথা বলবে…. .মানুষ যখন তার স্বক্ষমতায়, আত্মবিশ্বাসে, সুস্থ অহম বোধে, জগতে নানা কাজে নিজেকে নিয়োজিত করছে… সে তার সম্পূর্ণ স্বরূপ না? ওই শেষ জীবনে বিপন্নাবস্থাই তার আসল? বালাইষাট! এমন মানবনিন্দা আমি শুনিনি বাপু! সে তুমি যতই ভালো ভালো লেখা লিখে থাকো না কেন।
যা হোক যে হাবজিগাবজি বকছিলাম। তাকিয়ে থাকার কথাটা। সত্যি বলছি মানুষের আত্মা আছে কিনা জানি না। তবে নানা অসম্পূর্ণতা, স্ববিরোধে মেশানো, এই অদ্ভুত কথা-কওয়া দুই পেয়ে জীবের এ এক বিশাল ক্ষমতা কিন্তু….. কিছু না চেয়ে শুধু তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা।
রবীন্দ্রনাথের ছড়া নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধে দারুণ একটা উপমা আছে। একটা দীঘির জলে যেমন ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ছায়া ভেসে যায়, তার কোনো মানে নেই, তেমনই গোটা সংসারের টুকরো টুকরো দৃশ্য নিয়েই তৈরি হয় ছড়া।
এই তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিত্তে জন্মায় এক অর্থহীন ছড়া। তার ছন্দ আছে। মানে নেই। ওই অর্থহীনতাতেই ছুটি পায় মানুষ। নিজের হাত থেকে। শান্ত হয়। নিজের অজান্তেই। এই তাকিয়ে থাকার জন্যেই তো আয়োজন….. অমন একটা ভিতরেও তাকিয়ে থাকা যায়…. ওই যে গানে আছে না…. ”কে সে মোর কেই বা জানে”…. ”নিভৃত নীলপদ্ম” এর জন্য ডুব দেবে দাও…. ”মন চেয়ে রয় মনে মনে….. হেরে মাধুরী”..... হবে…. হয় হোক….
থাক মন, থাক। ওসব কথা থাক। ও কথার কথা না। ও সুরের কথা। ডুবলে ডোবো। ভাসলে ভাসো। শুধু তাকিয়ে দেখো…যেদিকে হোক....দেখো রে নয়ন মেলে…..