টুনটুনিদের দুই ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। এখন তাদের ঝাড়া হাত-পা। রোজ নতুন করে পুরোনো গল্পগুলো করে, নতুন করে পুরোনো রান্নাগুলো করে, নতুন করে পুরোনো হাসি হাসে, পুরোনো কান্না কাঁদে। আর সুখে থাকে।
তাদের গাছের সামনে যে নদী, সে রোজ রাতে হাত পা ছড়িয়ে বসে। চুল খুলে দেয়। চুলের মধ্যে আকাশের তারারা জোনাকি হয়ে খেলে, লুকোচুরি। তার নীল পাড় দেওয়া কালো শাড়িতে হাওয়া খেলে যায়। টুনটুনির বউ আর টুনটুনি দেখে। মুগ্ধ হয়।
একদিন রাতে হল কি, সেকি কি কাণ্ড। টুনটুনিরা বসে বসে পুরোনো গল্প নতুন করে করছে, এদিকে আকাশ মুখ কালো করে নদীর পাশে বসে। নদীও চুপ, আকাশও চুপ। আকাশের ঘন কালো কোঁকড়ানো চুলের মধ্যে দিয়ে খেলে যাচ্ছে বাতাস। কিন্তু দু’জনের মুখ ভার।
টুনটুনিরা নেমে গিয়ে বসল ওদের পাশে। জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে গো?
আকাশ বলল, দেখো না গো, চাঁদের আধখানা হারালো কোথায়, আর পাওয়া যাচ্ছে না। টুনটুনিরা তাকালো, তাই তো, আধখানা চাঁদ গালে হাত দিয়ে বসে।
বর টুনটুনি বলল, কি হবে? সব জায়গায় খুঁজেছ?
বউ টুনটুনি বলল, সমুদ্র, মাঠ, জঙ্গল… সব?
নদী আর আকাশ দু’জনেই বলল, সব সব সব।
এবার উপায়?
দু’জন টুনটুনি পড়ল চিন্তায়।
হঠাৎ বউ টুনটুনি বলল, আচ্ছা নদী দিদি, তোমার বুকের উপর ওর গোটা শরীরটার ছবি পড়ত না? তুমি ওটা দেখালে কেউ বানিয়ে দেবে না?
নদী চমকে উঠে বলল, তাই তো… দাঁড়াও।
এই বলে সে নিজের মধ্যে ডুবে টুক করে গোটা চাঁদের ছবি নিয়ে এলো। টলমল করছে সে ছবি। আকাশ বলল বাতাসকে, তোরা একটু স্থির হ। দেখি ভালো করে।
চাঁদ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, বাকিটার কি হবে গো….
বর টুনটুনি বলল, আরে সোজা ব্যাপার, আমার সঙ্গে এসো।
সবাই মিলে বর টুনটুনির পিছন পিছন চলল। প্রথমে বউ টুনটুনি, তারপর নদী, তারপর আকাশ আর আধখানা চাঁদ, সব শেষে বাতাসের দল ডিগবাজি খেতে খেতে।
একটা বড় বুড়ো বট গাছের তলায় সবাই এলো। একজন বেশ বয়স্ক মানুষ বসে বসে তামাক খাচ্ছে। তার সারা গায়ে কত পোকা কিলবিল করছে। শিকড়ে শিকড়ে মাথা ঢেকে আছে।
বর টুনটুনি বলল, ও মাটি দাদু, আমাদের খুব বিপদ, আমাদের একটু সাহায্য করবে?
বুড়ো গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, কি? ওই বাকি আধখানা চাঁদ বানাতে হবে তো?
বউ টুনটুনি আকাশের কানে কানে বলল সব টের পেয়ে যায় আগে থেকে দাদু।
বর টুনটুনি বলল, হ্যাঁ দাদু.. দেখুন না….
চাঁদ আধখানা শরীর নিয়ে দাদুর পায়ে পড়ে বলল, দিন না বানিয়ে…. আমি আপনাকে ঘিরে ঘিরে আজীবন ঘুরব। কথা দিলাম।
তখন দাদু বলল, বেশ। তবে একটা শর্ত। আমি রোজ রোজ বানাতে পারব না। অল্প অল্প করে পনেরো দিন ধরে বানাবো তোমাকে, সেটাই মেনে নিতে হবে। মাসে একদিন খালি গোটাগুটি হবে। তারপর আবার আমাকে আমার মাটি ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে পনেরো দিন ধরে। আর একদিন পুরো হাপিশ হবে। ওই সময় এসে আমার কাছে মাপ দিয়ে যাবে। আমি আবার করে বানাবো। হবে?
সবাই বলল, হবে হবে হবে।
কিন্তু হিসাব রাখবে কে?
অমনি একটা বাচ্চা ছেলে কোত্থেকে একটা বড় চাকা লাঠি দিয়ে মেরে মেরে ঘুরাতে ঘুরাতে এসে বলল, সে আমি খেলতে খেলতে হিসাব রাখবখন। আমি তো রাতদিন খেলিই।
সবাই বলল, সাধু, সাধু, সাধু।
এরপর থেকে টুনটুনিরা রোজ চাঁদের বড় হওয়া আর ছোটো হওয়া দেখে। পুরোনো গল্প নতুন করে বলে, শোনে। আর এই নতুন গল্পটা রেখে দিয়েছে নাতিনাতনিকে বলবে বলে। তাদের নাকি নতুন ডানা হয়েছে। এখান থেকে গন্ধ পায় তারা নতুন ডানার। তারা আসছে।