আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি যতদূর মনে পড়ে। ঠাকুমা অসুস্থ হলেন। বাড়িতে ডাক্তার এলেন। তিনি এক বিচিত্র কাপড় ঠাকুমার স্থূল বাহুতে বেঁধে, নিজের কানে দুটো বাঁকানো পাইপ গুঁজে, একটা যন্ত্রে চঞ্চল কাঁটা দেখে বললেন, ওঁর প্রেশার বেড়েছে অনেক, যে কোনো দিন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
বাড়ির সবাই গম্ভীর হল। ঠাকুমার বিছানা থেকে ওঠা বারণ। সবার ভাবগতিক দেখে ভয় পেলাম। একে তাকে খুঁচিয়ে বুঝলাম ঠাকুমার জীবন সংশয়। ভীষণ ভয় পেলাম। কারণ ঠাকুমার সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক। সে মানুষটা চলে যাবে? সেও কি হয়? না হতে দিতে হয়?
যা হোক ধীরে সুস্থে ঠাকুমা সুস্থ তো হলেন কদিনেই। কিন্তু আমার ভয় গেল না। ডাক্তার বলেছেন ওষুধটা খেয়ে যেতে হবে, আর আপাতত ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু চেম্বার ভর্তি লোকের মধ্যে বসে ডাক্তারবাবু যখন আবার সেই যন্ত্রে ঠাকুমার হাত বেঁধে দেখছিলেন, আমার মনে হচ্ছিল ভয়ের ব্যাপারটা একমাত্র ওই যন্ত্রই ডাক্তারকে বলে। ওই আসল।
সুশীল মাষ্টার। আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সাদা প্যাণ্ট, সাদা শার্ট। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। সুন্দর কণ্ঠস্বর। মাঝারি উচ্চতার, সুঠাম দেহ, সুন্দর উজ্জ্বল প্রসন্ন মুখ। একদিন স্কুলের উঠান দিয়ে ক্লাসরুমে ফিরছি, দেখি সুশীল মাষ্টার তাঁর বাজারের ব্যাগ থেকে ওই একই যন্ত্র বার করে হেডমাস্টারমশাইয়ের হাত বাঁধছেন। আমি তো তাজ্জব! শৈলেন ডাক্তারের যন্ত্র আমার মাষ্টারের ঝোলায় এল কী করে?
যা হোক ক্লাসে তো ফিরলাম। কিন্তু মনে ভীষণ উত্তেজনা। কী করে বলব সুশীল মাষ্টারকে, আমার ঠাকুমার ভারি বিপদ! তুমি যাবে একবার তোমার ওই যন্ত্র নিয়ে?
ছুটির ঘন্টা পড়ল। আমার বুক ধুকধুক করতে শুরু করল। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম হাওড়া সালকিয়ার সরস্বতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বড় হল ঘরে, যেখানে মাষ্টারেরা মাঝে বেঞ্চ পেতে বসেন, সামনে বড় টেবিল, আর চারদিকে ক্লাস রুম ঘিরে।
আমি সামনে দাঁড়ালাম। উনি টেবিলে ঝুঁকে কী একটা লিখছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, কিছু বলবে?
ব্যস, আমি সবটা বলেই ফেললাম। উনি আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসো?
এ প্রশ্নটা এমন স্পষ্ট করা যায়, এ বাক্যটাকে এমন স্পষ্ট উচ্চারণ করা যায়? হ্যাঁ ভালোবাসিই তো। ভালোবাসা মানে কি হারিয়ে ফেলার ভয়?
আমাকে বললেন, দাঁড়াও, আমি এই কাজটা সেরেই যাচ্ছি। খানিক বাদে স্কুলের উঠানে রাখা দেওয়ালে ঠেসান দেওয়া ওঁর বাংলা সাইকেলটা নিলেন, আমাকে বললেন, বোস।
আমি এর আগে কখনও সাইকেলে বসিনি। সামনের রডে বসলাম। উনিই বসিয়ে দিলেন। বসতে বসতে দেখলাম সাইকেলের সামনে ঝোলানো বাজারের ব্যাগ, আর তার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে সেই যন্ত্র।
যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি থেকে স্কুল… স্কুল থেকে বাড়ি রোজ যাই, সেই রাস্তাই সাইকেলের রডে বসে উঁচু থেকে দেখতে অদ্ভুত লাগতে লাগল। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি পার হওয়ার সময় মাষ্টারমশাই বললেন, এই বাড়িতে কে থাকেন জানো? আমি বললাম, হ্যাঁ, গান লেখেন, জেঠু বলেছেন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
এরকম কথা হতে হতে আমাদের গলিতে ঢুকলাম। সরু গলি। সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমারও উঁচু থেকে সবাইকে এই সরু গলির মধ্যে থেকে দেখে কী অবাকই না লাগছে! সঙ্গে ক্রিং ক্রিং করে মাষ্টার বেল দিচ্ছেন।
বাড়িতে তো সুশীল মাষ্টারকে দেখেই হইচই পড়ে গেল। মা বকলেন, এরকম মাষ্টারকে কষ্ট দিতে হয়? ঠাকুমা তাকালেন। কেমন তাকানো বলতে পারি না। কিন্তু খুব গরমে হাঁটতে হাঁটতে যদি কোনো ছাওয়া দেখতে পাই, ওই জাতের তাকানো মনে পড়ে মাঝে মাঝে এতটা বলতে পারি।
যা হোক, ঠাকুমা শুলেন চিৎ হয়ে। সুশীল মাষ্টার পাশে বসে সেই যন্ত্রটা বার করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম শৈলেন ডাক্তারের মত উনিও সব জানেন। যিনি বোর্ডে চক দিয়ে লিখে লিখে পড়ান, তিনি এও জানেন! আশ্চর্য! আমি আড়চোখে দেখলাম, মা, জেঠিমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। আমি আর ওদের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না।
উনি একটু পর হেসে বললেন, কোনো ভয় নেই বাবু! সব ঠিক আছে।
ঠাকুমা উঠে পড়লেন। তারপর শুরু হল আতিথিয়তা। মাষ্টার লজ্জা পাচ্ছেন, বিব্রত হচ্ছেন। আমি ওঁর অবস্থা দেখে আরো সঙ্কুচিত হয়ে ঘরে সেঁধিয়ে গেলাম। একটু পর মা ডাকলেন, বাবু, বাইরে এসো, স্যার যাচ্ছেন।
আমি সামনে দাঁড়ালাম। মা বললেন, প্রণাম করো। করলাম। মাষ্টারমশাইকে দরজা অবধি এগিয়ে দিলাম। ফিরে এলাম। কেউ বকল। কেউ প্রশংসা করল। ঠাকুমা তো এ গল্প প্রায় আমরণ সবাইকে শুনিয়েছেন। গর্বের সঙ্গে। সুশীল মাষ্টার মাঝে মাঝেই ঠাকুমার কথা জিজ্ঞাসা করতেন।
আজ কদিন হল ওঁর সেই শুভ্র শান্ত প্রসন্ন মুখটা মনে পড়ছে। ওঁর সেই প্রশ্রয়। ওঁর সেই স্নেহ। নাও তো করতে পারতেন। সাইকেলে আসার সময় আমাকে বকাঝকাও করতে পারতেন। সবাই যখন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন বড় মানুষ, উদার মানুষ হওয়ার ভান করতে অসুবিধা হয় না। একটা উৎসাহ থাকে। কিন্তু কেউ যখন তাকিয়ে নেই, নিভৃতে, একজন ক্লাস থ্রিতে পড়া বাচ্চার সামনে বড় মানুষ যে হয়, সে সত্যিই বড় মানুষ।
জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, মান-অপমান, বিপদ-সম্পদের ভিতর দিয়ে গেছে, যাচ্ছে, যাবেও। এই স্বাভাবিক। একে বেশি বিশ্লেষণ করতে গেলে এর কোনো অর্থ নেই। রবীন্দ্রনাথের কথায় আছে, মূর্তিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে শুধু মাটিই পাওয়া যায়, শিল্পীর আনন্দকে পাওয়া যায় না। জীবনে এক শান্ত আনন্দের ধারা তো আছেই। নিজের মধ্যের সব ক্ষোভ, সব প্রতিহিংস এ সব মিটিয়ে নিলেই সে আছে। ভীষণভাবে আছে। সেও অমৃত। দেহের অমৃতে অধিকার নেই, চিত্তের আছে।
যে সুশীল মাষ্টারকে অন্যভাবে চেনে, সে হয় তো বলবে, কিন্তু তার যে এই এই দোষও আছে। থাকতে পারে। কোনো মানুষই দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। পরকে নিয়ে অনধিকার চর্চা করতে গেলে তার গুণের দিকে তাকানো একপ্রকার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আজকের এই সোশ্যালমিডিয়র যুগে তো তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।
আজ বাংলা নববর্ষের এই প্রথম দিনে আমার প্রণাম থাকল সুশীল মাষ্টারের জন্য। আপনারাও যদি এ লেখার মুখোমুখি হন দৈবাৎ, তবে আমার প্রণাম ও শুভেচ্ছা জানবেন।