যে যাবার সে তো যাবেই। কিন্তু যাওয়ার কি সময় হয়েছিল? কিন্তু পৃথিবীতে এই প্রথম তো নয় যে কেউ অকালে চলে গেল। তবে?
রাতে ঘুম আসে না। এলেও মাঝরাতে ভেঙে যায়। জানলা দিয়ে সজনে গাছের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে। সজনে গাছের ফাঁক দিয়ে কখনও চাঁদ দেখা যায়। আবার দেখা যায় না। এ পাশ, ও পাশ করতে করতে রাত কেটে যায়। এতবড় রাত! এত অসহ্য রাত! এত নির্মম রাত!
ভোর হয়। কোনোদিন ভোরে চোখে ঘুম নেমে আসে। ক্লান্তির ঘুম। বেলা গড়িয়ে সজনে গাছের ফাঁক দিয়ে দিনের আলো ঢোকে। তার গায়ে পড়ে। সে চোখ মেলে। বুকের মধ্যে একটা খালি খাঁচা। সে খাঁচার দরজা খোলা। এদিক ওদিক ওর ছেড়ে যাওয়া স্মৃতিরা ছড়িয়ে। তাকে কিছু বলার নেই ওদের। ছেড়ে যাওয়ারও নেই। যাবে কোথায়? বেঁচে থাকতেই বা তাকিয়েছিল নাকি কারুর দিকে কোনোদিন? আজই বা যাবে কোথায়?
ক্লান্ত শরীরটা। কিসের ক্লান্তি? কোনো মারণ রোগে ধরল নাকি তাকেও? পা'টা মাটিতে রাখে। সারাটা শরীর টাটিয়ে ওঠে যন্ত্রণায়। নিজের বিমুখ প্রাণের ভারের থেকে বড় ভার যেন কিছু নেই আর। প্রাণ কি চাইলেই যায়? নিজেকে শেষ করে দেবে? সে তো শরীরটা থামবে। কিন্তু হৃদয়?
এসে দাঁড়ালো পুকুরঘাটে। বেলা হয়েছে। জলটা টলটল করছে হাওয়ায়। আগে এ সবের মানে ছিল। এই পুকুর। এই গাছপালা। এই রাস্তাঘাট। এই লোকের যাতায়াত। কথাবার্তা। হাসিকান্না। সবার মানে ছিল। এখনও কি সবাই কথা বলছে আগের মত? তার কানে আসছে না শুধু? আগের দিনের মতই কি তারা আজও তার নাম ধরে ডাকে? সে শুনতে পায় না শুধু?
পুকুরে নামল। কোমর অবধি জল। ওইপারটায় বড় বড় সুপুরিগাছের সারি। তার ওপারে ঘন বাঁশঝাড়। ওদিকে ও এসে দাঁড়াতো আগে। তার স্নান করা দেখত। ও যদিও বলত, স্নান দেখতাম না। দেখতাম তোমাকে ঘিরে পুকুরের জলের আদেখলাপনা। তোমার চুলের কাছে নেমে আসা আকাশ। তোমার বন্ধ চোখের উপর খেলে যাওয়া বাতাস। মানুষ কি শরীরকে ভালোবাসে? মানুষ প্রাণের অতল থেকে উঠে আসা একটা ব্যথায় সাড়া দেয়। সেই সাড়া দেওয়াকে বলে ভালোবাসা। সবার সাহস হয় না। কারুর কারুর হয়। যত সাড়া দেয়, তত ব্যথা বাড়ে। জীবন গড়ায়। ব্যথা জীবনের দেওয়ালে রঙ করে। সুখ আঁকে। দুঃখ আঁকে। একদিন সব মুছে চলে যায়। এই হয়।
আর যে সাড়া না দেয়?
পুকুরের জলে ঢেউ তুলে জিজ্ঞাসা করেছিল সে।
যে সাড়া না দেয়, সে শুকিয়ে মরে। দেখো, হয় ব্যথায় মরবে, নইলে শুকিয়ে। এই নিয়ম। তোমায় যখন গভীরভাবে পাই, তখনও কি তোমায় সম্পূর্ণ পাই? যত পাই তত শূন্যতা বাড়ে। তত মনে হয় তুমি দূরে। আরো দূরে। মানুষের হৃদয় কি মরীচিকা? যত কাছে যাও, সে তত দূরে। যত ধরবে বলে হাত বাড়াও, সে ততই অধরা। কেন বলতে পারো? কেউ জানে না।
পুকুরের ঠাণ্ডা জলে মাথাটা ডুবিয়ে ওপারে তাকালো। কেউ নেই। ফাঁকা। কী ভীষণ ফাঁকা। একদিনও এসে দাঁড়াতে পারো না আরেকবার? জিজ্ঞাসা করতে পারো না, কেমন আছি আমি? কেমন আছ তুমি? আমারও তো জানতে ইচ্ছা করে।
নিজের ডানহাতটা দিয়ে, সবটুকু জোর দিয়ে পুকুরের ওপারের দিকে ঢেউ দিল ঠেলে। ঢেউ যেতে যেতে তার দিকে তাকালো। ধীর হল তার গতি। তবু গেল। ওপারের তীরটা ছুঁলো। কত ক্ষীণ তার গতি। কী শীর্ণ তার শরীর। শূন্য পাড়, তবু সে ছুঁলো। আসবে না? হোক সে ঢেউ শীর্ণ। হোক সে ক্ষীণ। তবু আসবে না?
হঠাৎ কী হল? বাতাস উঠল জোরে। ওপারের সুপুরিগাছগুলো আরতির চামরের মত উঠল দুলে। কয়েকটা সুপুরিফুল এসে পড়ল জলে। জলে উঠল ঢেউ। ঢেউয়ে ভেসে ভেসে সুপুরির ফুল আসতে লাগল তার দিকে। ওই তো আসছে। সে সাদা আঁচলটা দিল মেলে। আঁচলে ভরল জল। সে জলে ভাসল আকাশের নীল ছবি। ধীরে ধীরে সুপুরির ফুলগুলো এসে ঠেকল তার আঁচলে। ভরল তার আঁচল একে একে। তার চোখ ভরে উঠল জলে। প্রচুর জলে। প্রচুর প্রচুর জলে।
ভালোবাসা মানে তো ব্যথা। দুষ্পরিহর ব্যথা।