আচ্ছা, এই যে এত এত ডাক্তারি পরামর্শ চলছে রাতদিন ফেসবুক জুড়ে, আসলে নকলে মিলে করিছে হাহাকার। এগুলোর দায় কারোর নেওয়ার নেই না? এ যেন সেই খেলা, কিছু একটা হাতে লুকিয়ে - "বল তো কোন হাতের মুঠোয়" বলে দুটো মুঠোই বন্ধ করে দেওয়া খেলা। এবার তুমি আন্দাজে বলো কোনটা ঠিক। একে সরকার ভ্যাক্সিনের কোন ডোজ কখন দেবে এই সংশয়ে পাঁজি দেখে দিন স্থির করতে ব্যস্ত। এই পাঁজিতে যদি বলে এত দিন পরে নিলে ভালো তবে সেই কথা ঘোষণা করে দিচ্ছে, আবার যদি অন্য পাঁজি বলে যে, না না অতো দিন তো নয়, এতদিন পরে নিলে ভালো... ব্যস, অমনি আবার দিন বদলে যাচ্ছে।
এর ওর টাইমলাইন, এত এত খবরের কাগজের এত এত ভুরি ভুরি চিকিৎসা পদ্ধতির এমন নিখুঁত বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, যা স্বয়ং পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারি পাশ করতেও অত পড়েননি ওনারা। ফলে কি হচ্ছে জানেন? এক্কেবারে নিজের চোখের সামনে দেখা সদ্য ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা বলি। আমার এক পরিচিত মানুষ অসুস্থ, মানে করোনা আক্রান্ত। আমার এক বন্ধু চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললাম। আমার বন্ধু চিকিৎসক তিনি যথাসাধ্য ব্যবস্থাপত্র করে পাঠালেন। তারপর কি হল? তারা তার উপর কাটছাঁট করে ওষুধ খেতে শুরু করলেন। এবং যা হওয়ার তাই হল, জটিলতা বাড়ল। আমার চিকিৎসক বন্ধুটি বললেন, এরকম অভিজ্ঞতা তার হামেশাই হচ্ছে। লোকে সবটা মানছে না। কেন মানছে না বলুন তো? কারণ আপনার আমার শেয়ার করা নানাবিধ বালিতে চিনিতে মেশানো তথ্য আর কিছু হীনবুদ্ধি খবরের কাগজের তিলকে তাল করা সংবাদ পরিবেশন। এরাই এক সময় তিলকে তাল করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভ্যাক্সিন নিয়ে এমন গল্প ফেঁদেছিল যে মানুষ ত্রাসে ভ্যাক্সিন নিতেই যায়নি সেই সময়ে। এমন সব বর্ণনা যে আপনার সামনে ভ্যাক্সিন আনা মাত্র আপনি ভিরমি খেয়ে অক্কা পাবেন, জানতেও পারবেন না। অথচ এত কোটি মানুষের ভ্যাক্সিন হয়ে গেল ওই খবরের কাগজওয়ালাদের দেখেছেন সেই সবের পার্শ্চপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আর লিখতে? না, এখন অন্য খেলা যে।
মোদ্দা কথা আপনি ভয় না পেতে চাইলেও আপনাকে ভয় পাওয়ানো হবে, আপনি দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচতে চাইলেও আপনাকে দুশ্চিন্তায় রাখা হবে। তারপর বলা হবে প্যানিক করবেন না। মানে ওই “পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়” গোছের কথা আরকি।
কারা সত্যিকারের সমস্যায় পড়েছেন জানেন? চিকিৎসককূল। রোগী এত জেনে যাচ্ছেন যে তারা নিজের কথাটা বলার আগে রোগীর অল্পজ্ঞান, অতিজ্ঞান, অসংগতজ্ঞান ইত্যাদির জঙ্গল সাফ করতে করতে হেদিয়ে মরছেন। আমার এক আত্মীয় থেকে থেকেই নিজের শরীরে ব্ল্যাক ফাংগাস খুঁজছেন। তা খুঁজবেন না? শঙ্করাচার্য মশায় বলেছিলেন শব্দজাল মহারণ্যম। শব্দজাল মহা অরণ্যের তুল্য। আজকের যুগে জন্মালে হয় তো বলতেন সংবাদজাল মহারণ্যম। এখন সবাই তো আর ঝোপঝাড় বেছে বিশল্যকরণীর সন্ধান করতে পারেন না দাদারা, দিদিরা। সে কাজটা না হয় থাকুকই না পাশ করা চিকিৎসকদের হাতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। সবার উপরে পাব্লিক ডিম্যাণ্ড। মানুষ চায় চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে যদি এইসব পড়েটড়ে নিজেকে সামলে রাখা যায় তবে ক্ষতি কি? বিশাল ক্ষতি দাদা গো। রামকৃষ্ণদেব বলতেন বৈদ্যসঙ্গ না করলে কোনটা কফের নাড়ি, কোনটা পিত্তের নাড়ি বোঝা যায় না। তা সেই সঙ্গ কি আর সুমনের বৈঠকখানায় হয়, না আমার মত হেঁজিপেঁজির টাইমলাইনে শেয়ার করা নানাবিধ কোভিড নিবারক টোটকাগুণে হয় গো দাদারা দিদিরা। এই তো শুনলাম একজন তার আত্মীয়কে খবরের কাগজ, এর ওর টাইমলাইনের কায়দা অনুযায়ী প্রোন করাতে গিয়ে মেরেই ফেললেন। তাই সত্যিই বলছি ব্যপারটা খুব সিরিয়াস জায়গায় চলে যাচ্ছে। আর এই সব করবেন না প্লিজ। দরকার হলে সত্যিকারের ডাক্তারের সঙ্গে টেলিপরামর্শ নিন, কিন্তু দোহাই খবরের কাগজ আর ফেসবুকের উপর নির্ভর করে জীবনগুলোকে এভাবে বিপন্ন করবেন না। নিজের চিকিৎসা করা বন্ধ করুন।
শুধু কি তাই? এরপর আছে সেন্টিমেন্টাল ডোজ। কে মারা যাওয়ার আগে কাকে গান শুনিয়েছেন। কার মারা যাওয়ার আগের কান্নার জলে কোন চিকিৎসক কেঁদেছেন। ভাইরে আমার, সেন্টিমেন্টের উপর আমার শ্রদ্ধা সম্মান আছে। কিন্তু এখন এই মেলোড্রামার সময় নয়। চিকিৎসকদের কান্নাকাটি করা ছাড়া অনেক কাজ আছে। কি অমানুষিক লড়াই যে লড়ে চলেছেন পরিগণ্ডির মধ্যে একজন চিকিৎসক থাকলেই বুঝবেন। সিউডো চিকিৎসা আর সেন্টিমেন্টাল গালগপ্পো ছেড়ে আসুন না রোজ আসল জিনিসের খোঁজ রাখি। কার কি দরকার। কার কোউইনে রেজিস্টার করতে অসুবিধা হচ্ছে। কে নেটে টাকা ভরেনি বলে অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না। মানে আমার চারপাশটা আরকি। বেশি দূরের কথা ভাবার দরকার নেই রে ভাই। গাজার যুদ্ধে অনাথ হয়ে যাওয়া বাচ্চার জন্য কষ্ট পাওয়া অনেক সোজা, পাশের বাড়ির বাচ্চাটা কেন অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে না সেটার প্রতি সংবেদশীল হওয়ার থেকে, জানি তো। দাদারা সেন্টিমেন্টাল হবেন না প্লিজ। মানবিক হোন। সেন্টিমেন্ট দায়দায়িত্বের ধার ধারে না। অনুকম্পা রাখে। তখন আপনার আর ফেসবুকে পড়ে পড়ে নিজেকে ডাক্তারও মনে হবে না, আর ওসব সেন্টিমেণ্টাল খবর পড়ে আহাউহু করতেও প্রাণ চাইবে না।
আমি আবারও একই কথা দিয়ে শেষ করি, চিকিৎসকদের কাজটা দুরূহ করে তুলবেন না প্লিজ। যা বলছেন তাই অন্ধের মত শুনুন। অসুবিধা হলে ওনাদের জানান। পরামর্শ নিন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। মনে রাখবেন এই মহাযুদ্ধে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিকায় অনেক কিছু করার যেমন থাকে, তেমন অনেক কিছু না করাটাও কর্তব্যের মধ্যে বর্তায়।