Skip to main content
sob ki

সন্ধ্যে হব হব। ত্রিবেণীর শিবমন্দিরের চাতালে বসে আছি। হয় তো আরতি হবে একটু পর। এক একজন করে মহিলা আসছেন। মন্দিরঘেরা চাতালে বসছেন। গল্প করছেন। সংসারের নানা খুঁটিনাটি, সুখদু:খের গল্প। সব গল্প চেনা। যেন আমারই বাড়ির গল্প। একজন বয়স্ক মানুষ নাতির হাত ধরে এসে দাঁড়ালেন মন্দিরের সামনে। মহাদেবের জন্য ততটা নয়, যতটা নাতির ঘন্টা বাজানোর জন্য। দাদু নাতিকে শক্ত করে ধরে কোলে তুললেন। নাতি দড়িটা হাতে নিয়ে ঢং ঢং করে বাজাতে লাগল। পাশে মহিলাদের মধ্যে একজন গলা উঁচিয়ে বললেন, ও দাদা, মেয়ে কদ্দিন থাকবে?

নাতির ঘন্টা বাজানো কাঁপা কাঁপা শরীরটা দুই শীর্ণ হাতের বেড়ে আটকে বললেন, দেখি… মনে হয় কালই চলে যাবে…

হাই পাওয়ারের চশমার ভিতর দিয়ে যে কষ্টটা ঠিকরে শিবের গায়ে লাগল, ওটা ‘যেতে নাহি দিব’ কষ্ট। একজন মহিলা বললেন, দাদা মেয়ের বাড়ির নাতি-নাতনির এই এক জ্বালা… আমারটাও তো….

সংসারের গল্পের এই এক সুখ। কথা শাখা-প্রশাখা বেয়ে কোনদিকে যে বয়ে চলে! কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। অববাহিকা বলতে ছাতি। আর তার মধ্যে পোষা ভালোবাসার ছটফটানি।

দাদু নাতিকে কোল থেকে নামিয়ে, পাঞ্জাবির হাতায় কপালের ঘাম মুছে বললেন, আসি….

মহিলাদের দু-একজন বললেন, আসুন… সাবধানে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। দাদু নাতিকে কোল থেকে নামাতে চাইছে না। নাতিও কোলে থাকতে চাইছে না। সে বারেবারে বলছে, নামি… নামি…..

দাদুর সেই অসহায় জেদ… যেতে নাহি দিব… কাল সকালেই তো চলে যাবি…. থাক না… আরেট্টু…. সে নেমেই ছাড়ল।

খানিক দূরেই ত্রিবেণী শ্মশান। দেহের পর দেহ আসছে। কালো ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে সন্ধ্যের আকাশে। খোলে নামসংকীর্তন বেজেই যাচ্ছে, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ….

তবু যেতে দিতে হয়। দিতেই হয়।

======

"আপনারা কি বডি নিয়ে এসেছেন?"

চমকে তাকালাম। মূল শিবমন্দির ঘিরে দু-ধারে আরো কয়েকটা ছোটো ছোটো শিবমন্দির। তার উপরে বসে একজন মহিলা। মলিন পোশাক। চুল উসকোখুসকো। কিন্তু মুখের পেশীর মধ্যে একটা তীক্ষ্ম দৃঢ়তা। যেন ভাগ্য কাবু করেছে, জব্দ করতে পারেনি।

না না, এমনি বেড়াতে এসেছি বন্ধুরা….

ওহ্‌… সরি… আমি না জেনে… ভালো করেছেন…. ও বেলি… মা কেমন আছেন?

একজন কিশোরী। হেঁটে আসছে। তাকে জিজ্ঞাসা করছেন। সে মেয়ে বলল, মা ভালো আছেন পিসি…

উনি আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, থার্মালের দিকে যান… ওখানে খুব সুন্দর ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের আশ্রম আছে… খুব শান্ত… যান…

যাই। বলার মধ্যে যেন আবদার। যাও না, বসে আছ কেন? রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছ যখন যাও। থেমে থেকো না।

বাইক স্টার্ট দেওয়া হল। আসি তবে?

উনি বললেন, দুগ্গা… দুগ্গা….

কিছু মানুষের ভালোবাসা এমন ঘাসের মত, দেখেছি সংসারে। পায়ে দলে যাওয়াও যায়, আবার হাত বোলানোও যায়, আদরে। যা খুশী।

এই এক জটিল হিসাব সংসারে। সব কিছু করার স্বাধীনতা আছে। কাউকে আঘাত করার, অত্যাচার করার, ভালো ব্যবহার করার, না করার। সব কিছুর স্বাধীনতা আছে জগতে। কিন্তু অধিকার কি আছে? এই প্রশ্নের উত্তর যার পাওয়া হয়ে গেছে তার কাছে অনেক কিছু সহজ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা দেওয়া আছে যা কিছু করার, কিন্তু অধিকারবোধটাকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হয়… করব কি?

=====

জায়গার নাম ফাঁসিতলা। একটা পুরোনো বড় লোহার গেট। তার পাশ দিয়ে লোহার গোল চাকতি লাগানো দরজা। একজন একজন করে ঢুকে গেলাম। গঙ্গার পাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে আশ্রম। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। খুব মধুর স্বরে নামসংকীর্তন ভেসে আসছে।

গঙ্গার ধারে দাঁড়ালাম। তারপর মন্দিরের দিকে এগোলাম। সুর আসছে যেখান থেকে। ফাঁকা মন্দির। বিরাট হলঘর। সামনে কয়েকটা মূর্তি। অনেক সন্ন্যাসীর। ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের। মা কালীর। মহাপ্রভুর। রামানুজের।

একজন সন্ন্যাসী বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে নাম গাইছেন। ডাকছেন। ডুবে আছেন। ডুবতে বলছেন। এসো বসো।

কি গাও? কাকে ডাকো? এত বড় শূন্য জগতে তোমার গাওয়া নাম পৌঁছাচ্ছে কোথায় সন্ন্যাসী?

এই যে এখানে… চন্দন আঁকা বুকে… দেখো… ডুবে দেখো… বাইরে অনেক আছে…. ভিতরে এক….

সে সাড়া দেয়?

আমার ডাকই তাঁর সাড়া… এই নামই আমার তৃষ্ণার জল…. তৃষ্ণা তিনি… জলও তিনি…. এত একা কেন? এত দূরে কেন? এত আঘাতে আঘাতে এ তীর, সে তীর ভেসে বেড়ানো কেন? চুপটি করে বসো। তর্ক থাক। বিচার থাক। চুপ করো। সুরে ডোবো।

"প্রসাদ নিয়ে যাবেন।"

একটা কাগজের বাটিতে মুড়কি, বিস্কুট আর বাতাসা দিয়ে গেলেন।

গঙ্গার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মুড়কি মিষ্টি। বাতাসা মিষ্টি। কানের মধ্যে দিয়ে নাম মিষ্টি সুরে মনের উপর প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছে। এবার ফিরতে হবে। একজন কি পরম আকুতিতে ডাকছেন, আমি তোমারই…আমি তোমারই… আমি তোমারই…. তুমি আমারই… তুমি আমারই… তুমি আমারই….

তর্ক নয়। যুক্তি নয়। একজন মানুষ কাউকে, কোনো সত্যকে পরম জেনে নিজেকে সমর্পণ করছেন। গদগদ ভাষে বারবার বলছেন, আমি তোমারই… আমি তোমারই…

সে দিচ্ছে না পার্থিব সুখ… বা অমরত্বের আশ্বাস…. না সুখের আশ্বাস… সে কি দিচ্ছে তবে?

সে দিচ্ছে সমস্ত ভালোবাসাকে মোহনায় নিয়ে যাওয়ার সুখ। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সুখ। হারিয়ে যাওয়ার সুখ।

======

ফেরার পথ। চা পিপাসা। চায়ের দোকান মহাতীর্থ। সব ধর্মের মানুষ। গতকাল গেল ঈদ। আজ অক্ষয়তৃতীয়া। পাশাপাশি। কারোর মাথায় ইসলামি টুপি, কারোর কপালে শিবের ত্রিশূল আঁকা টিপ। ওই তো একটু উঁচুতে উঠলে দরগা। ওই তো এগোলে আরেকটু, জগন্নাথ মন্দির। সব আছে। স্বমর্যাদায়। তুমি আমি কে? মহাকালের বিন্দুর বিন্দু। মর্যাদা রাখলে সব থাকে। মাঝির নৌকা ডোবানোর স্বাধীনতা তো আছেই। চাইলেই পারে। কিন্তু পারে নিয়ে যাওয়াই তার কর্তব্য। তাকে অধিকার দেওয়া হয়েছে শুধু ওইটুকুরই। এটা বোঝো মন… বোঝো…. নত হও… নত হও…. যেখানে নত হবে সেখান থেকেই শুরু…. সুরের… মিলনের…. সব কি আর এমনি এমনিই… পাগল!

 

(ছবিঃ Suman Das)

Category