Skip to main content

যখন ছোটোবেলায় মামাবাড়ি যেতুম, মানে উড়িষ্যায়, আমার মামারা প্রবাসী বাঙালি, সেখানে রাস্তায় কারোর সঙ্গে দেখা হলেই, হয় "জুহার আঁগিয়া" বা "রাম রাম" এরকম কোনো একটা সম্ভাষণ আসত। বড়দের মধ্যেই অবশ্য। এর পর ভারতের নানা জায়গায় দেখেছি দেখা হলেই প্রথমে হয় "রাম রাম" নয় "রাধে রাধে" ইত্যাদি বলে সম্ভাষণের একটা প্রচলন আছে। 

    বাংলায় সেরকম কিছু আছে? বাংলায় আছে,"ভালো আছেন"? যার উত্তর শুনতে হয় আমার সত্যিকারের কোনো উৎসাহ নেই, বা সময় নেই। ওই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া আরকি। অথবা যারা নিজেকে পাশ্চাত্যের ছিন্নমূল ভাবে তারা সাহেবি কেতায় 'গুড মর্নিং' গোছের প্রহর অনুযায়ী সম্ভাষণ করেন। আবার কেউ কেউ তার তর্জমা করে, শুভ সকাল বা সুপ্রভাত বলেন। অবিশ্যি এই সম্বোধনের অত্যাচার অনেকেই মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে রাতদিন নিশ্চয়ই পান। 

    আমাদের সেই অর্থে কোনো সম্ভাষণ নেই। হয় কপট প্রশ্ন নয় সাহেবি কেতা। কোনো কোনো সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে একটা 'জয়গুরু' সম্বোধন করেন যদিও, তবে সেটা খুবই মুষ্টিমেয়। সেটা ঠিক এখনও বাঙালিয়ানা পায়নি। 

    আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি। শিক্ষক মশায় ক্লাসে আসলে উঠে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আমাদের 'গুড মর্নিং স্যার' বলতে কেউ শেখাননি। আমরা বলিওনি। এখন সব বাচ্চারা শুনেছি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সেইভাবেই 'গ্রিট' করে। এটা বেশ ভালোই। 

    আসলে আমি পড়াতে গিয়ে দেখেছি আমাদের মধ্যে মিউচুয়াল রেসপেক্টটা ভীষণ কম। না হয় এক অদ্ভুত সমাজসিদ্ধ জড়তা। আরো টের পাচ্ছি এই অনলাইনের চক্করে এসে। ধরুন আপনি ক্লাসে জয়েন করলেন। এইবার শুরুটা কি দিয়ে করবেন? আপনি যদি গুড মর্নিং বলেন, একজন দু’জন বলবে, বাকিরা মিউট মোডে। অগত্যা "শুনতে পাচ্ছিস কিনা" এরকম ধরণের অবজেক্টিভ কথায় শুরু করতে হয়। যেখানেও তারা মারাত্মক নন রেসপন্সিভ। আমি মফস্বল এলাকায় থাকি বলে কিনা জানি না, এত অদ্ভুত ব্যবহার ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভের বাচ্চাদের দেখে অবাক হতে হয়। ধরুন আপনি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কিছু একটা জানতে চাইলেন, এই বইটা আছে কিনা, বা এই নোটস আছে কিনা। কারোর কাছে থাকলে উত্তর পাবেন, না থাকলে তারা চুপ করে থাকবে। এটা যদি একজন দুজনের ক্ষেত্রে হত ভাবতাম এটা তার স্বভাব, কিন্তু আদতে এটা আপামর ছেলেমেয়েদের স্বভাব। এটা কি দোষের?

    আদৌ তা নয়। এটা দোষগুণের কথাই নয়। ওই যে বললাম আমাদের মিউচুয়াল রেসপেক্টটা ভীষণ কম। গভীর শ্রদ্ধাবোধ আমাদের মধ্যে সব সময় রেডিমেড মোডে থাকবে তা নয়। আমাদের নানা মুড নানা অবস্থায় হতেই পারে। সৌজন্য কথাটার জন্মই সেই জন্যে। সে ওই তাৎক্ষণিক যোগাযোগের রাস্তা বানিয়ে সে অভাবটা পূরণ করে দেয়। আমরা একটা স্বাভাবিক সুস্থ রাস্তা পাই। কিন্তু এই সৌজন্যবোধ কথাটাও খুব সম্মানের না আমাদের কাছে। "আমার সঙ্গে ওসব সৌজন্যতা দেখাতে হবে না"... এ খুব বহুশ্রুত কথা। সৌজন্যবোধটা যে শেখার জিনিস, নিত্য জীবনে রপ্ত করার জিনিস এটা আমাদের সামাজিক বিধানে খুব একটা কোনোদিনই নেই। ভক্তিবোধ আছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ইত্যাদি আছে। কিন্তু সে বড় অতিরিক্ত। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবও বারণ করে বলেছেন ওসব মানসেই ভালো। কিন্তু সৌজন্যবোধটা সম্পূর্ণ আলাদা। সৌজন্যবোধ দিয়ে সামাজিক আদানপ্রদানের রাস্তাটা সোজা হয়। কিন্তু সেটা তো আর ধুম করে বিনা অভ্যাসে জন্মায় না। তার জন্য রীতিমতো একটা মানসিক, সামাজিক অনুশীলন দরকার। 

    তো যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, একজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতে একজন মানুষ কি কথাটা দিয়ে শুরু করবেন সেটা নিয়েই আমাদের কোনো প্রথা তৈরি হয়নি। খুব পরিচিত হলে এ সমস্যা হয় না। কিন্তু যার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বের বা আত্মীয়তার সম্পর্ক, সেখানে আপনি কিভাবে সম্ভাষণ করবেন তাকে? নমস্কারটা খুব দূরের সম্পর্কে হয়। খুব কাছের সম্পর্ক হলে? ওসব দরকারই হয় না। কিন্তু যে জন আছে মাঝখানে? হয় সাহেবি কায়দা, প্রহর অনুযায়ী অথবা কপট প্রশ্ন, "কেমন আছেন?" যদিও সাহেবি কায়দায় এর একটা হাও ডু ইউ ডু এর তর্জমা হয়। তবু সে যেন সম্ভাষণ হল না। অথচ আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যে কি দারুণ সব সম্ভাষণ থাকত না? সেকি তবে শুধু সাহিত্যেই ছিল? বাঙালির সম্ভাষণ নিয়ে সমাজ বিশেষজ্ঞদের কি মত তবে?