সৌরভ ভট্টাচার্য
 6 January 2018              
    
  আজ রামকৃষ্ণ জিতে গেলেন। বলেছিলেন না, “চালকলা বাঁধা বিদ্যা আমার চাই না”। কি স্পর্ধা না এক মূর্খ বামুনের? এতবড় এডুকেশান সিস্টেম, এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষিত মানুষ তৈরির উপায়। এত গবেষণা, এত গবেষক, এত শিক্ষক, এত অধ্যাপক, এত স্কলার... সব শেখালো, শুধু অসুস্থ মাকে কি করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, সেবা করতে হয়... না ‘সেবা’ কথাটা আবার সেকেলে, কি করে take care করতে হয় আর শেখাল না। 
 
        তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। যখন ছেলেটা হাত ধরে তাকে ছাদে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কি বিশ্বাসে তার হাতদুটো ধরে ছাদের দিকে হাঁটছিলেন না? সেই হাতদুটো, যেই হাতদুটো ছিল একদিন খুদে খুদে, তাকে আঁকড়ে থাকত, বাঁচত। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, মানুষের বাচ্চা পৃথিবীতে সবচাইতে অসহায় হয়ে জন্মায়। তার মা তাকে কোলে তুলে স্তন না দিলে সে বাঁচে না। সত্যিই তো তাই না? সেই ছোট্টো হাতদুটো দিয়ে মাকে আঁকড়ে ছাদের কার্ণিশের পাশ দিয়ে হাঁটা মাকে জড়িয়েও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা। ধুর, এসব সেন্টিমেন্টাল কথার কি দাম আছে? ওটা তো বাড়তি। আমাদের পারফেক্ট হতে হবে যে? 
        তিনি অধ্যাপক ছিলেন। তিনি অধ্যাপক ছিলেন। তিনি অধ্যাপক ছিলেন। ভুল টাইপ করছি না। ইচ্ছা করেই লিখছি। কারণ শিক্ষার আলো... বাতি... জ্যোতি... ইত্যাদি কত কত কথা মনে আসছে যে। একি কথা? আপনি খামোখা মাত্র একজন অধ্যাপকের অপরাধে অধ্যাপনাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন কেন? 
        কারণ এতবড় সিস্টেমে, একটা একটা ধাপ পেরিয়ে মানুষটা যখন এত উঁচু ধাপে এসে দাঁড়ায়, সে তো একদিনে নয়। কত পরীক্ষা। কত যোগ্যতার মাপকাঠির মানদণ্ড পেরিয়ে সে আজ এই জায়গায়। এতগুলো যোগ্যতা বিচারের মানদণ্ড তবে কি মাপল? আজ অপরাধীর তালিকায় শিক্ষাজগতের সাথে জড়িত ব্যক্তির সংখ্যা তো কম নয়। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির চেষ্টায় তো শিক্ষক মহলের নাম বেশ এগিয়ে। 
        আমার মনে পড়ছে একটা ঘটনা। আমার মা তখন বেশ অসুস্থ। আমার এক ছাত্রীর বাবা আমার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি অধ্যাপক পেশায়। আমার ঘরে আমার মুখোমুখি বসলেন। বললেন, আপনি নাকি অমুক জায়গায় একটা অফার পেয়েছেন চাকরীর? বললাম, হ্যাঁ। বললেন, যাচ্ছেন না কেন? বললাম, মাকে এই সময়ে ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। উনি ব্যাঙ্গাত্মক হেসে আমায় বললেন, একদিন এই দিনটার জন্য আপনি পস্তাবেন। মা কারোর সাথে চিরটাকাল থাকেন না। আপনার বাবার দায়িত্ব তাকে দেখা। আপনার নয়। আপনি টাকা পাঠিয়ে দেবেন... ইত্যাদি। 
        আমি শুনছি না, এবং বিরক্ত হচ্ছি সেটা ওনাকে হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলাম। ওনার ইগোতে লাগলো। আমায় বললেন, দেখুন সত্যিটা আমিও জানি আপনি কেন যাচ্ছেন না। বলেই চেয়ারটা আমার আরো কাছাকাছি এনে ফিসফিস করে বললেন, এই সব ডাগর ডাগর মেয়েদের এত কাছ থেকে পাওয়া... আমরা যারা শিক্ষকতা করি আর কারা পায় বলুন? 
        না, নাটকীয়ভাবে আমি ওনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিইনি। আমি হেসেছিলাম। আর মনে মনে আমাদের শিক্ষিত হওয়ার অভিমানটার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম। আমার সত্যিই বলতে করুণাই হয়েছিল। 
        আমি আবারও বলছি, কোনো পেশাকে ছোটো করার জন্য লিখছি না কথাগুলো, আমিও এক অর্থে এই পেশার সাথেই যুক্ত। আমি শুধু বলতে চাই, আমাদের যেন মনে থাকে আমরা পাখিটার গান বন্ধ করে একটা সোনার খাঁচাই বানাতে পেরেছি শুধু এতদিনে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে একটা যন্ত্রের দৃষ্টিতে দেখে, তার কর্মক্ষমতা, কুশলতা বাড়াতে পারে মাত্র, তার আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে একমাত্র জ্বলন্ত জীবন্ত আত্মাই। আবার রবীন্দ্রনাথে ফিরি, তিনি বলছেন, তাই বলে সেই গুরুদের কোথায় পাই? আমাদের যে মাষ্টার দিয়ে কাজ চালাতে হয়। 
রামকৃষ্ণ বলছেন, “যে পণ্ডিতের বিবেক-বৈরাগ্য নাই, তাকে খড়কুটো বোধহয়।” এটাই কথা, খুড়কুটো। কোন খড় কতটা ছাঁটলে কি কাজে কতটা ব্যয় হবে, তার হিসাব সোজা, কিন্তু সে খড়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা অত সোজা কাজ কি? প্লেটো তার কালজয়ী গ্রন্থ – ‘দ্য রিপ্লাবিক’-এ বলছেন চারটে প্রাথমিক সত্যের কথা – সাহস, প্রজ্ঞা, সংযম আর ন্যায়পরায়ণতা। এইগুলিই একটা মানুষকে মানুষ করার, একটা দেশকে মাটি-জল-পাথরের হিসাবের বাইরে গিয়ে একটা সভ্যতা গড়ার ভিত গঠন করে দেয়। সে কথা না শুনেছে তারা, না শুনেছি আমরা। 
        আজ শিক্ষার অন্ধকার চারদিকে। বড্ড অন্ধকার। যতটা হয়ত মানুষের না জানলেও হত তার চাইতে কোটিগুন বেশি জেনে ফেলেছি, যতটা অনুভবের দরকার ছিল, যতটা প্রজ্ঞার দরকার ছিল তার চর্চার ভাঁড়ার থেকেছে শূন্য। চূড়ান্ত অসামঞ্জস্য চারদিকে। কিন্তু একটা মানুষের শেষ ধাপ তো একটা অনুভব। মানুষ মানে একটা অনুভব। একটা শিশু যখন জন্মায়, সে এই জগতটাকে চেনে অনুভবেই, চিন্তায় নয় তো! চিন্তা তো অনুভবের অনুগামী। চিন্তা থেকে যা জন্মায় তা আবেগ, অনুভব না। যদিও দেখতে একই রকম। তাই আবেগ ভুল করতে পারে, কিন্তু অনুভব নয়। কারণ সেটা চিন্তার পূর্ববর্তী। চিন্তার জননী। অনুভব passive, আবেগ active. 
        এই অনুভবের শোধন পরিমার্জন হবে কি করে? সেকি একার কর্ম? সেকি ব্যক্তিগত প্রয়াস? আমার মনে হয় না। অনুভব একটা ঋতুর মত। মানুষের সমাজে এক একটা ঋতু আসে অনুভবের জগতে। বর্ষা, বসন্ত, শীত ইতাদির মত। তখন আমরা সবাই সেই ঋতুর দ্বারা প্রভাবিত হই নিজের নিজের মানসিক গঠন অনুযায়ী। আজ আমাদের বড্ড সংকীর্ণ অনুভবের ঋতু। সব কিছুকেই বড্ড ছোটো দৃষ্টিতে দেখছি। অথচ হাতের আর পায়ের নখগুলোকে এত তীক্ষ্ম করে ফেলেছি যে চলতে ফিরতে নয় অন্যের শরীর কাটছে, নয় নিজের। প্রচণ্ড শিক্ষিত যে আমরা। থেমে যাওয়া হৃৎপিণ্ডকে আবার যন্ত্র লাগিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে আনতে পারি, পারছি না শুধু একটা শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়ে আবার বিশ্বাসের আলো জোগাতে। ঈশ্বরে বিশ্বাস নয়, মানুষের মধ্যে যে সুতোটা থাকে, যাতে একেকটা মানুষ গাঁথা থাকে সেই সুতোটার খেই ধরে রাখতে। পারব কি করে, এটা যে খুব খারাপ ঋতু চলছে। রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের গান না, ওই মহামানব আসে...
        আসবে, আসতেই হবে। এতগুলো মানুষের রক্ত মাড়িয়েই আসবে। ওই মায়ের রক্ত রাস্তা থেকে তো ধুয়েই যাবে... মহাকালের পাতা থেকে ধোবে কি? মনে হয় না। কারণ মহাকাল একটা সংখ্যা না। সব সংখ্যার গর্ভ। মহাকাল একটা চিন্তা না, অনুভব।