আমি অনেক নোবেল বিজয়ীর লেখা পড়িনি। নামও শুনিনি। এ কথা বলতে আমার লজ্জা লাগে না। হয় তো খানিক বাজার দর কমে তাতে।
তবে এ আমার অহংকার না। উপলব্ধি। তারাপীঠের মহাশ্মশানে বাউলের পায়ের কাছে বসে শুনেছি, সামান্য কী তার মর্ম জানা যায়…..
শুনতে শুনতে আমার প্রাণে এমন কুঠুরিতে আঘাত লেগেছে যে চমকে উঠেছি। বাউল লালনের গান একের পর এক গেয়ে গেছে, আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি আমারই প্রাণের পাড়ায় এ কুঠুরি ছিল….বন্ধ….দেখিনি তো! দেশবিদেশের এত জ্ঞানীগুণীর কথাই তো পড়লাম, কই এ কথা কেউ বলল না তো। “খুঁজিলে আপন ঘরখানা/ পাইবে সকল ঠিকানা”.... “আপনার আপন খবর নাই/ গগনের চাঁদ ধরবো বলে মনে করি তাই।/ যে গঠেছে এ প্রেম-তরী, সেই হয়েছে চড়নদারী/ কোলের ঘোরে চিনতে নারি, মিছে গোল বাধাই”।
বাউল আমাকে আমার হাত ধরিয়েছে। চিনিয়েছে। সেদিন থেকে জেনেছি বাজারদর কম পড়ুক, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু জীবনদর পড়ে গেলে আমার বড় ক্ষতি। তাই তাড়াহুড়ো, দৌড়াদৌড়িতে আর নেই। লালন কোনোদিন নোবেল পাননি। গোটা বিশ্বে অনেকেই চেনে ওঁকে। ওতে ওঁর কিছু আসে যায় না। আমারও যায় না।
একদিন এক অখ্যাত মেঠো বাউলের গান ট্রেনে মন দিয়ে শুনছিলাম বলে আমাকে একজন পণ্ডিত মানুষ বলেছিলেন, এই সব ভিখারিদের গানে কী রস পাও?
আমি উত্তর দিতে পারিনি। মাটি জলের সঙ্গে মিশে কাদা না হলে সে জলের মর্ম বোঝে না। নিজের সীমাও বোঝে না। বোঝে না কী ভঙ্গুর এক সত্তা সে।
অন্যথায় বড় বড় পুরষ্কার পাওয়া বইও যেমন আমাকে টেনেছে। তেমন অনেক কোনো পুরষ্কার না পাওয়া বইও আমাকে টেনেছে। আমার বিশ্বাস পাঠক সব বইয়ের জন্য সব সময় প্রস্তুত নয়। কোনো সদ্য পুরষ্কৃত বই পুরষ্কার পেয়েছে বলেই যদি খুলে বসি তবে সে বইটার উপর অবিচার হয়। সাহিত্য পাঠকের নির্জনে, নিঃসঙ্গতায় যে মান পায় সে-ই তার আসল মান।
একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও এও জানিয়ে রাখি, কোনো লেখক যদি বিশ্বাস করেন হিটলার তার হিরো, এবং সেই লেখকের সৃষ্টি যদি আমার পাঠকসত্তাকে তৃপ্তি দেয়, তবে আমার তার সৃষ্টিকে আদর করে ঘরে রাখতে কোনো সংকোচ হয় না। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন আশীর্বাদ করবেন, আমি যেন দরকার হলে শিয়াল কুকুরকেও আমার গুরুপদে বরণ করতে পারি। গুণের কদর করার জন্য ভিতরের চোখ লাগে, বাইরের বাজারি মানদণ্ড না।