আজকাল খুব শিরদাঁড়া নিয়ে কথা হয়। শিরকে যে দাঁড় করিয়ে রাখে সে-ই তো শিরদাঁড়া।
ঝুঁকে পড়া আর নম্রতা কি এক জিনিস? যে বাধ্য মানুষ, আজ্ঞাবহ মানুষ, ওবিডিয়েন্ট মানুষ, সে কি নম্র মানুষও? বিনয়ী কি চাইলেই হওয়া যায়, যদি সত্য অর্থে নিজের সীমাবদ্ধতার, ক্ষুদ্রতার জ্ঞান না থাকে? যে মানুষ কথায় কথায় ঝুঁকে পড়ে, সে মানুষের ভয় আছে, নয় মতলব আছে। ভয় বা মতলব থাকলে কি নিজেকে স্বচ্ছ দেখা যায়? আর নিজেকে স্বচ্ছ না দেখতে পেলে কি সত্য অর্থে নম্রতা জন্মায়? যে মানুষ বিনয়ী, সেকি জানে সে বিনয়ী? যদি জানে, সেটা আদৌ বিনয়? নাকি ফিগার অব স্পিচের মত ফিগার অব বিহেভিয়ার?
খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ... কেউ বাধ্য হতে বলছেন না। নম্র হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছেন। ঈশ্বরের কাছে বাধ্য হওয়া যায় না। নম্র হওয়া যায়। বাধ্য হওয়া যায় অরগানাইজড রিলিজিয়ানের কাছে। নানা মাঝারি গুরু, প্রতিষ্ঠান, নিয়মাদির কাছে। বাধ্য হওয়া যায় আইনের কাছে। কিন্তু নম্র একমাত্র হওয়া যায় ঈশ্বরের কাছে। যদি ঈশ্বর অর্থে বুঝি সত্য। নম্রতা সত্যি সত্যি না জন্মালে সত্যকে অনুভব করা যায় না। না যুক্তিতে, না চিত্তে। অহমিকার মোহে একটা আইডিয়াকে সত্য বলে মনে হয়। যার সঙ্গে বাকি সব কিছুর সঙ্গতি স্থাপন হয় না বলে সংঘাত বাধে। সত্যের ধর্মই সঙ্গতি। সামঞ্জস্য।
বাধ্যতা আর দাম্ভিকতা একই কয়েনের এপিঠ আর ওপিঠ। কথায় বলে শক্তের ভক্ত আর দুর্বলের যম। একই কথা। যে যত দাম্ভিক সে তত বাধ্য। নম্রতা প্রার্থনার বস্তু। আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। নম্রতা সাধনার সম্পদ।
আমরা সমাজে বাধ্য মানুষ চাই। নম্র মানুষ না। যার লোভ নেই তাকে বাধ্য করা যায় না। যার ভয় নেই তাকে আজ্ঞাবহ করে তোলা যায় না। আমরা ম্যানারিজম এর আছিলায় স্বার্থসিদ্ধির রাস্তা দেখিয়ে দিই। আজ্ঞাবহতা যত বাড়ে দাম্ভিকতাও তত বাড়ে। একদিকে খাওয়া চাবুকের আঘাত, আরেকদিকে ফিরিয়ে দেয় অহং। ঘরের লোক যাকে অত্যাচারি, দুর্মুখ বলে জানে, কাজের জগতে তাকেই মানুষ নম্র, ভদ্র বলে জানে। বলাবাহুল্য যে এখানে নম্রতা মানে আমি অবশ্যই ফিগার অব বিহেভিয়ার বোঝাতে চাইছি।
কোনো বাচ্চাকে শাসনের নাম করে, তার যুক্তিবুদ্ধি, প্রশ্নের ঝঞ্ঝাবায়কে অবরুদ্ধ যদি না করে দেওয়া যায়, তবে ধীরে ধীরে তার মধ্যে একটা সুন্দর, স্বাস্থ্যকর নম্রতার বোধ তৈরি হয়। ভারতীয় দর্শনে একটা সুন্দর শব্দ ব্যবহার হয়েছে এর জন্য, শ্রদ্ধা। এর কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ স্বয়ং স্বামীজি, অরবিন্দ করতে চাননি, আমি আর স্পর্ধা দেখালাম না। শ্রদ্ধা চিত্তকে সত্যকে ধারণ করার যোগ্য করে তোলে। কঠোপনিষদে আছে নচিকেতার মধ্যে শ্রদ্ধা প্রবেশ করল। উপনিষদ বলেন যা দাও শ্রদ্ধার সঙ্গে দাও। যা করো শ্রদ্ধার সঙ্গে করো। শ্রদ্ধার মধ্যে যে ভাবটা সেটাই নম্রতার পূর্ণতা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা ইংরেজির দৌরাত্ম্যে শ্রদ্ধাকে রেসপেক্ট শব্দে নামিয়ে এনেছি। ফলে একটা সামাজিক আচারের বেশি যেন তার আর কোনো মানে নেই।
শ্রদ্ধা নকল বস্তুতে জন্মায় না। শ্রদ্ধাকে মোহগ্রস্থ করা যায় না। শ্রদ্ধাকে সত্য বিমুখ করা যায় না। মানুষের যা কিছু চরিত্রবল এই একটা শব্দের মধ্যেই আছে - শ্রদ্ধা। স্যামুয়েল জনসন বলতেন, জ্ঞানহীন ইন্টিগ্রিটি দুর্বল, আর ইন্টিগ্রিটিহীন জ্ঞান বিপজ্জনক আর ভয়ংকর।
শ্রদ্ধা এই ইন্টিগ্রিটির জননী। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যদি আত্মশ্রদ্ধাহীন একটা বৌদ্ধিক কুশলী রক্তমাংসের স্নায়ুচালিত যন্ত্র করে তুলতে না চাই, তবে এখন থেকেই এ নিয়ে তৎপর হতে হবে। নইলে আপেল কেন মাটিতে পড়ল এ প্রশ্ন করার কেউ টিকে থাকবে না। কারণ আপেল গাছই থাকবে না। পরিবেশ-প্রকৃতি দূষণ থেকে চিত্ত দূষণ - একমাত্র রোধ করতে পারে শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা বাজারজাত না, সাধনজাত। ছাপা অক্ষর বদ্ধ না। জ্বলন্ত চিত্তের শিখা থেকে জাত। এর শিক্ষা ঘন্টা মিনিট ধরে ক্লাসরুমে হয় না। আঘাতে আঘাতে, জাগতে জাগতে আসে। যত আঘাত তত জাগরণ। যত জাগরণ তত আনন্দ। তত সঙ্গতি, তত সংহতি।