আজ টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী হিসাবে শিশুদের ব্যবহার করা নিয়ে একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসবের বাড়বাড়ন্ত বেশ কয়েক বছর ধরে হচ্ছে এটা স্পষ্ট। তরুণরা ডেইলি ব্লগ না ভ্লগ কী একটা বানাচ্ছে। ঘুম থেকে কাকভোরে উঠছে, স্নান করছে, ঠাকুরঘরে যাচ্ছে, কীর্তন করছে, মালা জপ করছে, নিরামিষ খাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এককালে বিজ্ঞাপনে বাচ্চাদের ব্যবহার করা নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কেউ শোনেনি। আজও বহু বিজ্ঞাপনের শিশুদের ব্যবহার করা হয়। কারণ? ওতে মানুষের মনে ছাপ পড়ে বেশি।
আসলে যা কিছুই কোনো -ইজম এর চোখে দেখা হয় সেখানেই একটা অর্ধসত্য ধরা পড়ে। রিলিজিয়ন, ফেমিনিজম, কমিউনিজম ইত্যাদি ইত্যাদি যা-ই বলি না, সেখানে আগ্রহটা প্রি-ডিটারামাইণ্ড, অগত্যা সত্যের খণ্ডাংশ দেখাই বাস্তব।
আশঙ্কা, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা ইত্যাদির সঙ্গে যোঝার পদ্ধতি সবার তো একরকম নয়। সব কিছুর মূলে আছে মানুষ আর তার বিচিত্র মন। বিচিত্র বলতে বলছি বৈচিত্র্যময় মন। তার গতিবিধিকে একটা দাগে টেনে এই হল ঠিক, আর বাদবাকি সব ভুল বলা সম্ভব নয়। মানুষের সুখ, আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আশঙ্কা, অ্যাংজাইটি? সেটা চিরকালের। কারণ ওই মন। আশঙ্কা, অ্যাংজাইটি তৈরি করে মন। তার অসম্ভব কল্পনাশক্তি।
মানুষ তার বাস্তব সমস্যার সমাধান বাস্তবেই খুঁজে নেয়। বাড়ি ভাঙলে মিস্ত্রী ডাকে। অসুস্থ হলে হাসপাতালে যায়। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে কোনো অমঙ্গল না হয় তার জন্য? সে তার কাল্পনিক দেবতার শরণাপন্ন হয়। হোমযজ্ঞপুজো করে। তার কাল্পনিক আশঙ্কার জন্য কাল্পনিক দেবতার আবাহন। এ মনোবিজ্ঞানের বোঝার জিনিস। নিন্দামন্দ করে এর থেকে মানুষকে বার করা যায় না। যে মানুষ তার প্রিয়জনকে হারিয়ে দেবতার কাছে তার দেহান্তরিত অস্তিস্ত্বের জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছে, সেও মনোবিজ্ঞানের বোঝার জিনিস। তাকে নিন্দা করে, মূর্খ দেগে কিছু হয় না। কারণ এটাই ধ্রুব যে কোনো মানুষ কোনোদিন সার্বিকভাবে মূর্খত্বের ঊর্ধ্বে হতে পারবে না। মানুষ এমনভাবেই কণ্ডিশণ্ড। আমি সব বুঝে ফেলেছি, আর তুমি ব্যাটা মূর্খ কিচ্ছু জানো না - এ মানসিকতা একজন ডিক্টেটর হওয়ার মানসিকতারই লাইট ভারসান।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যা হচ্ছে, সেগুলো আত্মপ্রচার আর অর্থলাভের টেকনিক। তবে এ নতুন কিছু না। ধর্মকে পুঁজি করে অর্থলাভের প্রথা বিশ্বজুড়ে বহু প্রাচীন। যে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পার্থিব ঐশ্বর্য দেখলেই তা সহজে অনুমেয়। কিন্তু আমরা সে সবের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখি। আমরা ভাবের ঘরে চুরি করে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ, ও হতেই পারে। যে মানুষ একটা দামী গাড়ি চেপে এসে জগতের সব পার্থিব সুখ ত্যাগ করতে উপদেশ দেয়, আমরা অনায়াসে তার পা ধোয়া জল খেয়ে তাকে তার দামী গাড়িতে চাপিয়ে তাকে গুরু বলে মেনে নিই, কারণ আমার বিশ্বাস সে মানুষটা অধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন।
হ্যাঁ, এই আরেকটা সুত্র - ক্ষমতা। আমি যেহেতু ক্ষমতা ভালোবাসি, তাই আমি অর্থ ভালোবাসি, রাজনৈতিক উচ্চপদ ভালোবাসি, কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদ ভালোবাসি, তেমনই অধ্যাত্মিক আধিকারিক পুরুষকেও ভালোবাসি। কারণ আমার লোভ। ক্ষমতার প্রতি আমার লোভ।
লোভ কি বাস্তব নয়? আলবাত বাস্তব! তবে সমস্যা কী? সমস্যা হল শিক্ষা।
একজন মানুষের দুটো জিনিস শিখতে হয়। একটা স্মৃতি নির্ভর নানাবিধ তথ্যজ্ঞান এবং নানা স্কিল বা প্রযুক্তির কৌশল, যা দিয়ে সে প্রফেশনাল হয়ে ওঠে। আরেকটা জীবনকে শেখা। বাঁচতে শেখা। ঘাতেপ্রতিঘাতে বাঁচতে শেখা। ধর্মীয় নানা প্রচলিত মত, নানাবিধ সামাজিক, রাজনৈতিক ইজম, অ্যাজেণ্ডা ইত্যাদি সরিয়ে খাঁটি জিনিসটা জানতে শেখা। বুঝতে শেখা। সেই আলো অনুযায়ী বাঁচতে শেখা।
এই শেখার রাস্তা আটকে দাঁড়ায় আমার লোভ, আমার ভয়, আমার অন্তহীন চাহিদা। আমার কিছু হোক আর আমি কিছু হই। আমি হই সফল। ওরা হোক লুজার।
আমার কিছু হোক, আর আমি কিছু হই - এ এক মায়াবী ফাঁদ। গোটা বিশ্ব এর বাইরে তার বাস্তবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার তাতে কোনো আগ্রহ নেই। আমার ইচ্ছা এগুলোতে, আমি কিছু হই আর আমার কিছু হোক।
এ কি অন্যায়?
কেন অন্যায় হবে? কিন্তু এর সঙ্গে প্যাকেজে ওই অ্যাংজাইটি আর আশঙ্কার পুনঃ পুনঃ আগমন কোনোদিনই শেষ হবে না। আমার আমাকে ঘিরে সাধ যত তীব্র ওদের দংশন ঠিক ততটাই তীব্র।
এর বিপরীতে আছে জীবন শিক্ষা। যেখানে জীবন খোলা মঞ্চে আহ্বান করে বলছে, ফাঁকা স্লেট নিয়ে এসো। যে স্লেটে কোনো হিসাব, কোনো মন্ত্র, কোনো তত্ত্ব থাকবে না। সব আমি হাতে ধরে শেখাব। তুমি অনুভব করবে তুমি আর বাদবাকি এই মানবজাতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ এক সমুদ্র। তুমি তার ঢেউমাত্র। গোটা মানবজাতটাই তোমার রক্তে স্পন্দিত হচ্ছে। তুমি গোটা মানবজাতির মধ্যে স্পন্দিত হচ্ছ। তোমার ও ব্যক্তিগত লাভলোকসানের হিসাব বড্ড তুচ্ছ। যদি সহ্য করে নিতে পারো বাইরে এসো। গোটা জীবন বাঁচো। নইলে রাতদিন এক টুকরো সুখ আর সুখের চারপাশে ঘেরা হাজার লক্ষ দুশ্চিন্তা, ভয় আর অ্যাংজাইটির বাদুড় চামচিকে নিয়ে বাঁচতে হবে। বাইরে দেখাবে তুমি সুখী। কিন্তু অন্তরে জানো কীসে পুড়ে যাচ্ছ তুমি রাতদিন। তুমি ঠিক করো তুমি কী করবে।
মন প্রবল ভাবনায় পড়ে। বুদ্ধি দিয়ে বুঝছি ঠিক। কিন্তু আমার চিত্ত কি এতটাই প্রস্তুত? কোনো মধ্যপথ নেই?
জীবন বলে, ভালোবাসলে সবটাই সোজা। কিন্তু আসক্ত হয়ে থাকলে ভীষণ দোটানা। ওদিকে প্রাতিষ্ঠানিক গুরু বলে, আমার কাছে এসো, এই নাও মন্ত্র, এতে তোমার সার্বিক মঙ্গল হবে। যাও নিজের ঘরে যাও। তোমার মঙ্গল হবে বলেই আমার আসা।
কিন্তু সবার মঙ্গল না হলে আমার মঙ্গল হয় কী করে?
এ প্রশ্ন কেউ করে না। যে সবার মঙ্গল চায় সে দেবালয়ে দাঁড়ায় না। সবার মধ্যেই তার বাস। কারণ যার মঙ্গল চাইছে আর যে মঙ্গলময় তাকে সে এক করে দেখছে। সেই দেখাতেই মঙ্গল। নইলে সবার মঙ্গল করো কথাটা মুখের কথা হয়ে দাঁড়ায় বা ক্ষণিক আবেগের। রাশিয়া ইউক্রেনকে তার মঙ্গলের বাইরে জেনেছে। ইজরায়েল প্যালেস্টাইনকে। প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে। আত্মীয় অন্য মানুষকে। এক পাড়া আরেক পাড়াকে। এক প্রতিষ্ঠিত ধর্ম আরেক ধর্মকে। এক দেবতা অন্য দেবতাকে। ফলে মঙ্গল শতধা হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কোথায় নীতি? কোথায় সততা? এ তো মতলব আর ক্ষুদ্র প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ! “হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান”?!