(ঘরটা খুব বড় না, খুব ছোটও না। একটা খাট। খাটে একজন বয়স্ক মানুষ আধশোয়া। জেগে আছেন। দৃষ্টি ছাদের দিকে। পাখাটা বন্ধ। সারাটা ঘর খুব গোছানো নয়, আবার আগোছালোও নয়। চারদিকে তাকিয়েই বোঝা যায় যে দীর্ঘদিন অসুস্থ মানুষটা। একজন মহিলা, পঞ্চাশের বেশিই বয়েস হবে, উনি কাপে কিছু একটা গুলছেন, ধোঁয়া উঠছে জল থেকে, মানে জলটা গরমই হবে। দেওয়াল ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে, সকাল সাড়ে ন’টা। যিনি বিছানায় শুয়ে, ওর নাম অনন্ত; যিনি দাঁড়িয়ে, ওর নাম বিশাখা।)
অ - একটু জল দেবে…
বি - দাঁড়াও…
(বিশাখা খাটের পাশে রাখা টেবিলের থেকে জলের বোতল তুলে, একটা ঝিনুকে ঢেলে, অনন্তের পাশে বসে, অল্প অল্প করে কয়েক ঢোক খাওয়ালো। তারপর আঁচলে মুখটা মুছিয়ে আবার আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।)
অ - আজ কত বছর হল?
বি - তিন বছর হবে।
অ - না না, আমার অসুখের কথা না, তুমি এ বাড়ি নেই…
(বিশাখা একটা চেয়ার টেনে খাটের পাশে এসে বসল।)
অ - ঝিনুকে না, আমায় অল্প অল্প করে গ্লাসেই দাও... মাথাটা একটু উঁচু করে দাও…
(বিশাখা খাটটার মাথার দিকটা চাবি ঘুরিয়ে একটু উঁচু করে দিয়ে আবার বসল আগের জায়গায়।)
অ - বললে না যে…
বি – আট ন’বছর তো হবেই…
অ - এটার দরকার ছিল, না?
(অনন্ত রুগ্ন মানুষ। মুখটা সরু হয়ে গেছে। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে। দাড়ি একগাল। নাকে চশমার দাগ। চশমাটা ডাঁটি খোলা অবস্থায় পাশের টেবিলে রাখা।)
বি - ছিল। অন্তত তুমি ভালো করে ভেবে দেখো যদি, অবশ্যই ছিল।
অ - অথচ দেখো, সেও বাঁচল না।
বি - দেখো পরিতোষ আজ বেঁচে আছে কি নেই সেটা তো কথা না। কথা হল আমার পরিতোষকে নিয়ে যে অনুভব। এক-একজন মানুষ মানে তো এক-একটা অনুভব, সেটা তো মানো? কাজের বাইরে যে সম্পর্ক আমি সে সম্পর্কের কথা বলছি। নইলে তোমায় ঠকাতাম। তুমি জানো লুকোচুরি খেলা আমার ধাতে নেই।
অ - আমার দিক থেকে কিছুর কি অভাব ছিল?
বি - না, আমার দিক থেকে অভাববোধ ছিল। সেটাকে অস্বীকার করে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে হয় তো চলতে পারতাম। আমি চাইলাম না। তুমিও পারতে না। হয় তো আজ এই সময়ে তোমার পাশে বসে তোমার হাত থেকে মুক্তির প্রার্থনা করতাম... তোমার মৃত্যু কামনা করতাম হয় তো…
(বিশাখার গলাটা ধরে এলো। অনন্ত বিশাখার চোখের দিকে তাকিয়ে।)
বি - কি জানো, সম্পর্ক জোর করে টানা যায় না, বিকার জন্মায়। আমাদের মধ্যে বিকারটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না…
অ - তবে কি অ্যাডজাস্টমেন্ট বলে কি কোনো কথা হয় না…
বি - অ্যাডজাস্টমেন্ট করতেও বিবেকের সায় লাগে... আমার ছিল না... আমি পরিতোষের সঙ্গে তো ঘর বাঁধতে যাইনি... আমি নিজেকে তোমাদের দু’জনের থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম…
অ - কিন্তু কেন? তুমি পরিতোষের সঙ্গে ঘর বাঁধলে আমার দিক থেকে তো কোনো অসুবিধা ছিল না। সে তো আমি তোমায় স্পষ্ট বলেছিলাম... তবে তোমার অসুবিধাটা কোথায় ছিল?
বি - ছিল না সে অর্থে। সাধারণ হিসাব তাই বলে আমি পরিতোষের সঙ্গে ঘর বাঁধব বলেই তোমায় ছেড়ে গিয়েছিলাম... কিন্তু মানুষের জীবন কি অতটাই একমাত্রিক? অন্তত আমার জীবন তো নয়... তুমি জানো সেটা…
অ - আমি না কিছুই জানি না, বিশ্বাস করো। যখন শুনলাম তুমি পরিতোষের সঙ্গেও থাকলে না, আমি তোমায় ভীষণ অহঙ্কারী ভেবেছিলাম। হয় তো তোমার পুরুষজাতের উপর বিদ্বেষ জন্মেছে সেটাও ভেবেছিলাম... কিন্তু এগুলো সবই আকাশকুসুম কল্পনা, আমি সত্যিটা কি আজও জানি না জানো।
(কথার ফাঁকে ফাঁকে গ্লাসে করে ঢোকে ঢোকে এনসিওর খাইয়ে যাচ্ছে বিশাখা।)
বি - পরিতোষ আমায় আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গেল। কলেজ, বাড়ি করে করে আমি একটা যন্ত্রমানবী হয়ে উঠছিলাম। তোমার চিন্তাভাবনা, তোমার অভ্যাস, তোমার ভালো লাগা, খারাপ লাগাগুলোতে এমন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম, যে আমি যেন এ বাড়িটায় থেকেও থাকছিলাম না। আমার ছায়া যেন ঘুরে বেড়াতো। বাবু যখন মাস্টার্স করতে বাইরে চলে গেল, আমি সেটা আরো স্পষ্ট করে বুঝেছিলাম। আমি আমার মধ্যে ফুরিয়ে যাচ্ছিলাম। সব বিবশ। সব একঘেয়ে। সব ভীষণ বিবর্ণ। অথচ তুমি আমাকে বুঝতেই পারতে না। তুমি অস্বাভাবিকতা বলতে বুঝতে চীৎকার, চেঁচেমেচি, কান্নাকাটি, ঝগড়া এইসব। কিন্তু দিনের পর দিন স্বাভাবিক আচরণের মধ্যেও যে একটা গভীর অসুখ লুকিয়ে থাকতে পারে, এতটা তলিয়ে তুমি না দেখেছ, না ভেবেছ। আসলে তলিয়ে দেখা বা ভাবা কোনোটাই তোমার স্বভাব নয়। তুমি ভীষণ সতর্ক বাঁচতে ভালোবাসো। তুমি বড়ই হয়েছ ওভাবে। তোমার বাবা-মায়ের এক ছেলে তুমি ছিলে। ওরকম তোলা তোলা করে বড় করলে যে কেউই তোমার মত হয়ে যেত। আমি চাইনি বাবু সেরকম হোক। তাই ওকে এত ছোটো থাকতে বাইরের জগতটা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা তৈরির দিকে এত যত্ন নিয়েছি। তুমি চাইতে না, মনে আছে?
(অনন্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। বিশাখা ছাদে এলো। ছাদের উপর ছাওনি আছে। একটা দোলনা আছে ছাওনির নীচে। বিশাখা দোলনায় বসতেই ক্যাঁচ করে শব্দ হয়ে দোলনাটা দুলে উঠল। বিশাখা দোলনাটার উপরের লোহার রডের দিকে তাকালো। মানে দীর্ঘদিন ব্যবহার হয়নি। বিশাখা উঠে ছাদের ধারে এসে দাঁড়ালো। কত নতুন নতুন ফ্ল্যাট হয়ে গেছে এই ক’দিনেই। কিছু বাড়ি শ্রী হারিয়েছে রঙ চটে, এদিক ওদিক ভেঙে। সময় কাউকে রেয়াৎ করে না। কাউকে না। বিশাখা আবার দোলনায় এসে বসল। অল্প অল্প দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে দোলনাটায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হতে লাগল। সামনের ফ্ল্যাটে একজন মহিলা তার দিকে তাকিয়ে আছে ব্যালকনি থেকে। আয়া ছাড়া এ বাড়িতে অন্য মহিলা দেখে না বলেই চলে। বলতে বলতে দিনের আয়া কুমকুম এসে দাঁড়ালো।)
কু - বৌদি চা দিই?
বি - তোর স্নান হল? বাহ্, কি সুন্দর গন্ধ রে, এটা কি শ্যাম্পুর?
কু - হ্যাঁ বৌদি, খবরের কাগজের সঙ্গে একটা প্যাকেট দিয়েছিল। আমি প্যাকেটটা ফেলিনি। গন্ধটা ভালো না? পুজোয় কিনব। শরীর খারাপ ছিল তো, তাই আজ আমাদের শ্যাম্পু দিতে হয়। তুমি তো নাকি ঠাকুরদেবতাই মানো না, তো এসব…
বি - দাদাবাবু বলেছেন?
কু - হ্যাঁ তো, দাদাবাবুর শুধু তোমায় নিয়ে আর দাদাকে নিয়ে কথা। দাদা ভিডিও কল করলে রোজ কাঁদে। ফোন রাখার পর। বড় নরম মন গো দাদাবাবুর। অ্যাদ্দিন কাজ করছি, একদিনও গলা উঁচিয়ে কথা বলল না। একদিনও বলল না এই রান্নাটা খারাপ হয়েছে কুমকুম…
বি - যা চা নিয়ে আয়। দু’জনে গল্প করি। আদা দিস তো। আর চিনিটা কম দিস।
(বিশাখা দোলনায় দুলছে। চোখটা বন্ধ। ভুরুতে ভাঁজ। খানিকবাদে চোখটা খুলল। দু’ফোঁটা জল গাল গড়িয়ে পড়ল। ফোনটা অন করে কিছু একটা করতে করতেই কুমকুম দু’কাপ চা নিয়ে এসে হাজির হল।)
কু - দেখো তো চিনিটা…
বি - আহা, দারুণ রে... বোস... আরে নীচে কেন বসছিস... দোলনাতেই তো কতটা জায়গা... বোস... জানিস এই দোলনাটা আমার প্ল্যান ছিল... তোর বাড়িতে কে কে আছে?
কু - আমার মা বাবা আমি আর আমার মেয়ে।
বি - তোর বর?
কু - ছেড়ে গেছে…
বি – যা! তো শাখা সিঁদুর পরে আছিস কি কত্তে?
কু – বাহ্, মরেছে নাকি গো? বেঁচে আছে তো…
বি - কিন্তু সে তো অন্য কারোর সঙ্গে আছে নিশ্চয়ই…
কু - যা, তুমি কি করে জানলে?
বি - আরে চুলগুলো কি এমনি এমনি পাকল রে?
কু - জানো, একটা কথা বলব তুমি কিছু মনে করবে না তো?
বি - তুই ভেবেছিলি আমি তোর দাদাবাবুকে ছেড়ে অন্য মানুষের সঙ্গে ঘর করছি, এই তো?
কু - (লজ্জা পেয়ে) হ্যাঁ তো... তারপর দাদাবাবু বলল তুমি নাকি একাই থাকো... আমি তো অবাক... এমন মানুষের সঙ্গে ঘর করলে না…
বি - ঘর করা একটা কঠিন হিসাব রে কুমকুম। কে যে কার সঙ্গে ঘর করতে পারে আর পারে না, সে ঘর না করলে বোঝা যায় না। তুই কি বিয়ের দিন ভেবেছিলি যে মানুষটা কোনোদিন তোকে ছেড়ে যেতে পারে?
কু – না গো বৌদি... একদম বুঝিনি গো... আমি তো জানি এ ভাজা মাছটা উলটে খেতেই জানে না... তারপর তো দেখলাম উলটে কি গো... কাঁটাশুদ্ধ গিলে নেয় পাশের লোক আওয়াজ অবধি পায় না।
(কুমকুম আর বিশাখা দু’জনেই খুব জোর হেসে উঠল। একটা কাক কার্নিশে বসে ছিল, উড়ে গেল। সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা ঘরে ঢুকে গেল।)
কু - এখন হাসছি বটে। সে যা দিন গেছে গো। মনে হত সবাই ছিঁড়ে খেতে আসছে। মা বলত, বাবা মারা যাওয়ার পর, একা জিভ যেমন বত্রিশটা দাঁতের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলে, একা মেয়েমানুষের জীবন তেমন... মাঝে মাঝে তবু তো কামড় খেয়েই যায়…
বি - কামড় ছাড়া বাঁচতে পারতিস?
কু - ইস, তুমি কি গো?
বি - দেখ, আমি তো একাই কাটিয়ে দিলাম কতগুলো বছর…
কু - তুমি কলেজে পড়াও, তোমার সঙ্গে আমাদের তুলনা বৌদি... তবু তোমার একা লাগে না?
বি - লাগে। আমি গান শুনি, সিনেমা দেখি, রান্না করি। কোনোদিন একা একা নিজের জন্য বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না?
কু - মরে যাব গো। একবেলাই পারি না। একার জন্য রাঁধতে হয় যদি কোনোদিন, আমি মুড়ি ছাতু খেয়ে শুয়ে পড়ি…
বি - ওইজন্যেই তো মরিস রে... নিজেকে নিজে না গুরুত্ব দিলে অন্যলোকে কেন দেবে বল তো?
কু - নিজের জন্যে নিজে রাঁধলেই কি নিজেকে গুরুত্ব দেওয়া হয়? আমি যখন সাজের জিনিস কিনি, আমি যখন একা একা গ্রামের দিকে বেড়াতে চলে যাই, আমি যখন একা একা সিনেমা দেখতে যাই, সে তো নিজেকে ভালোবাসি বলেই বলো... নিজেকে গুরুত্ব দেওয়া আর নিজেকে ভালোবাসা কি আলাদা?
(নীচে ঘন্টার আওয়াজ হল।)
কুমকুম এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দাদাবাবু উঠে গেছে, গীজার অন করি, স্নানে নিয়ে যাব। তুমি আজ দুপুরে খেয়ে যেও কিন্তু, আমি নিজের হাতে তোমার জন্য দই-চিকেন করব। খেয়ে দেখো।
(শেষের কথাগুলো সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই বলে গেল। বিশাখা ফোনটা আবার হাতে নিল। রঞ্জিতার নাম্বারটা বার করল। বিশাখার ছেলের বউ। ওরা পুণেতে থাকে)
র - বলো আন্টি।
বি - রুদ্র অফিসে?
র - হ্যাঁ গো।
বি - তুই কি করছিস?
র - আরে জানো তো নেটফ্লিক্সে ডাউনটন অ্যাবি বলে একটা কি দুর্ধর্ষ সিরিজ এসেছে, ওইটাই দেখছি, তোমার ফোন বলেই ধরলাম, নইলে তোমার ছেলে কল করলেও ধরতাম নাকি ছাই…
বি - তোকে একটা কথা বলব? আউট অব দ্য বক্স…
র - বলো
বি - আচ্ছা, নিজেকে ভালোবাসা আর নিজেকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য হয় রে?
র - কেন গো, হঠাৎ?
বি - তোর বাবার এখানে এসেছি, কুমকুমকে চিনিস তো, ও জিজ্ঞাসা করল। দেখ তোর মত বি এইচ ইউ থেকে ফিলোজফি নিয়ে পাশ করা মেয়েকেও ভাবাচ্ছে... তাই না?
র – উফ্..., ফিলোজফি না, সোশিওলজি... তুমি খালি গোলাও, ওটা তোমার ছেলের আগের ওই ন্যাকা প্রেমিকাটার ছিল... কি যেন নাম, ঐন্দ্রিলা না স্বৈরিন্ধ্রী কি যেন...
বি - চুপ কর, আচ্ছা হিংসুটে তুই…
র - তোমার ছেলের মোবাইল ঘাঁটলে যে আরো কত বেরোবে আন্টি... রম্ভা, ঊর্বশী বেরোলেও তাজ্জব হব না…
বি - যা মা তুই তোর ওয়েব সিরিজ দেখ... মাথাটা গেছে... রাঁধবি না?
র - না গো খাবার অর্ডার করে দিয়েছি... আজ আর ইচ্ছা করছে না গো…
বি - বেশ, রাখলাম রে…
(বিশাখা ফোন রেখে ছাদের একটা ধারে এসে দাঁড়ালো আবার। নিজেকে ভালোবাসা, নিজেকে গুরুত্ব দেওয়া, নিজেকে প্রশ্রয় দেওয়া - এ সব কি এক? এগুলোর সংজ্ঞা কে ঠিক করে, সমাজ না মনোবিজ্ঞান?
বিশাখা নীচে নেমে রুদ্রর ঘরে ঢুকল, ওর ঘরটা একই রকম রাখা, যেন এখনও ও কলেজেই পড়ে। বিশাখা বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। ধুলো নেই। দেওয়ালে একটা ছবি আছে তিনজনের, পুরীতে তোলা। সে ছবিটার সামনে দাঁড়ালো। বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসে মাঝেমাঝেই। অথচ মাথায় কত চিন্তা। কত ছবি। বাবুর খাটে বসে মোবাইলটা অন করল। গ্যালারিতে গিয়ে পুরোনো ছবির অ্যালবামে গিয়ে পরিতোষ আর তার একসঙ্গে তোলা কিছু ছবি বার করল।)
প - তুমি কলপ কোরো না কোনোদিন। ভালো লাগে না। এই কয়েকটা সাদা চুল, এই যে দেখো, কি দারুণ। যেন তোমার জীবনের উপসংহার লেখার ডাক।
বি - মরে যাওয়ার সময় হয়ে এলো বলছ?
প - এই তোমার এক দোষ। সব কিছু ভীষণ চেনা প্যাটার্নে ভাবো। এ তোমার কত্তার জন্য হয়েছে। ও এরকম ভাবে চিরটাকাল। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা টিকে গেল স্রেফ ও একজন নিতান্ত ভালো মানুষ বলে, আর…
(পরিতোষ অর্থবহ হাসল, বিশাখা সমুদ্রের হাওয়া সামলে বলল, বুঝলাম...)
বুঝবেই তো। উপসংহার মানে শেষ না। মানে পরিণতি। মানে যেখানে এসে মানুষ বোঝে সে কিছু একটা বুঝতে শুরু করেছে।
বি - মানে মরে যাওয়ার সময় এলো তাই তো?
প - মরো, অন্তত যেভাবে বেঁচে আছো তার চাইতে সেই ভালো।
বি - তোমার এই কথাটা শুনলে আমার গা পিত্তি জ্বলে যায়। কি ভুল আছি আমি?
প - সে তো বোঝোই, কিন্তু মানবে না। এমন বিশ্রী একটা কম্ফোর্ট জোনে আটকে আছো তোমরা না?
বি - তোমরা মানে? আরো কাকে এ লেকচার দেওয়া হয় শুনি?
প - ঢং কোরো না।
বি - আমি ঠিক আছি।
প - নেই।
বি - তুমি সব জানো।
প - সব না জানলেও এটুকু অন্তত জানি যে তুমি ভালো নেই। নিজের সঙ্গে নিজের অবিচার করছ... নিজেকে খুঁজে বার করো বিশাখা... ভালোমন্দ লোকে যা হয় একটা কিছু বলবে, তোমায় কেউকেটা তো হতে বলছি না, নিজেকে নিজের ছন্দে নিয়ে এসো... এই এক ঘানি টানা জীবন তোমায় মানায় না... বেরিয়ে এসো…
দিদি গীজার অফ করলাম না। (কুমকুম এসে দাঁড়িয়েছে কখন খেয়াল করেনি বিশাখা।)
বি - না রে, আমি স্নান করেই এসেছি। তুই ওকে খাইয়ে নে, আমি এখানে থাকি একটু।
কু - তুমি খাওয়াবে না? দাদাবাবু…
বি - না রে, তুই খাওয়া... আমি একটু বসি…
(বিশাখা রুদ্রর একটা ফিজিক্স বই খুলে বসল। তার নিজের সাবজেক্টও ফিজিক্স। আচ্ছা বাবু কি সত্যিই ফিজিক্স পড়তে চেয়েছিল? পরমা একবার বলেছিল ও নাকি ফাইন আর্টস-এ যেতে চেয়েছিল। মিথ্যা কথা। সে নিশ্চয় পরমাকে ইমপ্রেস করার জন্য বলেছিল। সিম্প্যাথি সিকার। বাবার থেকে এ স্বভাব হয়েছে ওর। রঞ্জিতা ঠিকই বলেছিল, কত যে প্রেমিকা ওর। তবে রঞ্জিতাকে বিয়ে করবে ভাবেনি। এত অর্ডিনারি একটা মেয়ে। কোনো অ্যাম্বিশান নেই। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বাচ্চা, ধুর, দূরে আছে বরং ভালো আছে। পরিতোষ থাকলে বলতো, এ তোমার ছেলে বিশাখা? হতেই পারে না।
দুপুরের খাওয়ার পর রুদ্রের ঘরেই শুয়ে পড়েছিল বিশাখা। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছিল। এখনও করছে। অনন্ত আর বিশাখা সামনা সামনি। অনন্তর খাটটা উঁচু করা। পাশে ওর জপের মালা। রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত ও। ছেলেও।)
অ - বাবু আমার মত হয়েছে জানো?
বি - জানি না গো।
অ - জানো, কিন্তু মানো না। ও বলে, মা ঠিক আমাদের মত না, মা মায়ের মত।
বি - মানে স্বার্থপর, তাই তো?
অ - ঠিক তা না, ও বোঝে আমাদের মধ্যে কে কতটা ঠিক। আমরা নিজেরাও হয় তো অনেকটা বুঝি না।
(দু’জনেই চুপ করে বসে। ঘরের মধ্যে অন্ধকার বাড়ছে। সন্ধ্যে নামছে ধীরে ধীরে। বিশাখা উঠে গিয়ে আলোটা জ্বেলে আবার বসল অনন্তের পাশে।)
অ - কুমকুম কোথায়?
বি - বাজারে গেছে বললো। দেরি হবে ফিরতে বলে গেল। কিছু চাই?
অ - না, একটা চুমু খাবে আমায়? ঠোঁটে?
(বিশাখা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ অনন্তের দিকে। প্রতিমাসের ব্লাড রিপোর্ট হোয়াটস অ্যাপ করে দেয় কুমকুম তাকে আর রুদ্রকে। চুমুর কথা বলতেই অনন্তের লাস্ট সোডিয়াম পটাশিয়ামের রিপোর্টটা খেয়াল হল। একশো চল্লিশ আর ফোর পয়েন্ট থ্রি। ঠিকই তো ছিল যদ্দূর মনে হচ্ছে। তবে? ঠোঁটটা নামিয়ে অনন্তের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই অনন্ত কামড়ে ধরল বিশাখার ঠোঁট। এত জোর শরীরে ওর! চাপা ঘেন্না তো দু’জনের উপর দু’জনেরই আছে। তাই বলে এত? বিতৃষ্ণা মানে কি ঘেন্না? নীচের ঠোঁটটা কেটে যাচ্ছে বুঝতে পারছে বিশাখা। কিন্তু এখন ছাড়াতে গেলে বিপদ। এই শেষ দানের জন্য ওরা দু’জনেই অপেক্ষা করছিল যেন সারাটা জীবন। আজ চেকমেট হবে। অনন্তের চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে আসছে। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। যেন সঙ্গমের চূড়ান্ত মুহূর্ত। সে সময়েও এরকম অদ্ভুত তাকিয়ে থাকত অনন্ত। কি বিশ্রী বন্য চাহনি! একমাত্র পরিতোষ জানত অনন্ত স্বাভাবিক না। কিন্তু কিভাবে স্বাভাবিক না সেটা বোঝানোর মত শব্দ কোনোদিন পায়নি বিশাখা আর চেষ্টাও করেনি খোঁজার। এখন মনে হয় বাবুও হয় তো...।
অনন্ত ছেড়ে দিয়েছে। বিশাখা এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে এনে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। একবার মুখ ফিরিয়ে তাকালো। অনন্ত হাসছে। অনন্তের ঠোঁটে, দাঁতে বিশাখার রক্ত লেগে। অনন্তের চোখে ওটা বিদ্রুপ, না ভালোবাসা, না জয়ের হাসি বিশাখা বুঝতে পারল না। এ পুরোনো খেলা, কোনদিনই বুঝতে পারে নি। যেন নিরীহ লোমে ঢাকা হিংস্র পশুর বর্বর চামড়ার স্পর্শ। বিশাখার ঠোঁট থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে শাড়ি। হঠাৎ কি হল বিশাখার। অনন্তের সামনে দাঁড়ালো। পাশে রাখা মাথার বালিশটা নিয়ে চেপে ধরল অনন্তের উপর। অনন্ত ছটফট করছে। কি উল্লাসে যেন ফেটে পড়তে চাইছে বিশাখার মাথার মধ্যের সব শিরা। চীৎকার করে গান গাইতে ইচ্ছা করছে। জপের মালা আঁকড়ে ধরে আছে অনন্ত। একটু পরে সব শান্ত হয়ে গেল। বিশাখার মনে হল এক মুহূর্তে তার জীবনের কতগুলো বছরের ছেঁড়াপাতা আকাশে উড়ে গেল। আহা, শান্তি। শান্তি। শান্তি। শাঁখ বাজছে বাড়িতে বাড়িতে, সন্ধ্যে দিচ্ছে। বিশাখা রান্নাঘর থেকে চিনি এনে কাটা ঠোঁটে দিতে দিতে ভাবল, সেলাই পড়বে মনে হচ্ছে। কিন্তু ক’টা?)