তিনি মানুষ নন, তিনি মানুষ হয়ে আসেন।
টোটো এসে দাঁড়ালো শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে। বাড়ির নাম "ধ্রুবতারা"। আপাতত দু'দিনের জন্য এই আমার বাসা।
একটু পরে দেখা হবে অবসরপ্রাপ্ত বিশ্বভারতীর একজন বরিষ্ঠ চিত্রগ্রাহক, শ্রদ্ধেয় সমীরণ নন্দী'র সঙ্গে। তাঁর ছুটি শুধু প্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছে, ছবি তোলা থেকে কি করে হবে? সে তো তাঁর অস্তিত্বের প্রাণকেন্দ্র। তাঁকে জানিয়েছি, আসছি। শুধু অনেকগুলো বছর পর আসছি তাই নয়, একটা যুগের মহামারী পেরিয়ে আসছি। বেঁচে আছি এখনও, আজও, এ-ই আজ অনেক বড় কথা।
পরকে আপন করিবার শক্তি থাকা চাই, গুরুদেব লিখেছিলেন। সে শক্তি না থাকলে অপেক্ষা কিসের? দাদা এলেন। আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। গল্প হল। তারপর শুরু হল হাঁটা। বাড়ির পর বাড়ি। এই ভাঙা বাড়ি, একদিন এই বাড়িতে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এই সাজানো বাড়ি, এইখানে ছিলেন নীলিমা সেন। গল্প হতে হতে, এগোতে এগোতে এসে পড়লাম কিংবদন্তী মানুষ, শ্রদ্ধেয় সুনীতি পাঠকের বাড়ির দরজায়। ঢুকব? স্পর্ধা হবে না! সমীরণদাকে স্নেহ করেন। সেটুকু প্রশ্রয়ে পায়ের কাছে বসা যাবে না?
সমীরণদা জানলায় মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দাদা আছেন….
ভিতর থেকে স্নেহসিক্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, আরে সমীরণ, তোমার কথাই হচ্ছিল... এসো এসো….
আর কি। এই তো দরজা খুলে গেছে। এই তো সেই বৌদ্ধশাস্ত্র মন্থনকারী ধী। সমীরণদা পরিচয় করিয়ে দিলেন। দরকার ছিল না। সমীরণদার পিছনে পিছনে এসেছি মানেই আমিও তাঁর আপনজন। প্রণাম করতেই মাথাটা টেনে নিয়ে নিজের মাথার সঙ্গে ঠেকিয়ে নিলেন। বসলাম পায়ের কাছে। কি কথা বলব? ছেঁড়া ছেঁড়া কথা হল। কথা হাতড়ালাম। নেই। ভাষা স্তব্ধ।
ফিরে এলাম। এবার একা একা ঘোরার পালা। দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ আবার কাল।
=========
খোয়াইয়ের হাট বসেছে। গাড়ির পর গাড়ি ঢুকছে। কেউ ছবি আঁকছে, বিক্রি করছে। কেউ কাপড় জামায় নানা ছবি এঁকে, কল্কা এঁকে বিক্রি করছে। কত সাজসরঞ্জাম। ওদিকে সাঁওতাল নাচ হচ্ছে। মোবাইল ক্যামেরা, এমনি ক্যামেরা তাক করে শয়ে শয়ে। আমি কোথায় যাই?
আমি বরং হাঁটি। এখন শান্তিনিকেতনে অনেক শাসন। এখানে সেখানে লাল ফিতে, এদিকে সেদিকে দরজা বন্ধ। ছাতিমতলা, ওই যে দূরে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখো। তাই দেখি। মিউজিয়াম আছে। তাও দেখেছি। বুদ্ধি উত্তেজিত হয়েছে, বিস্মিত হয়েছে। কিন্তু হৃদয়? সে হাঁটবে। তাই তো রাস্তায়। যে রাস্তায় মহাজন হেঁটে গেছেন সে রাস্তায়।
চওড়া রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। গতকালের কথা মনে পড়ছে। এই সময় ছিলাম জয়রামবাটি, কামারপুকুরের মাটিতে। সেখানেও হেঁটেছি। রাস্তার ধুলো, গাছপালা, আকাশ সব স্পর্শ করেছি। কল্পনায়।
তিনি তো সচ্চিদানন্দ, সৎ-চেতনা-আনন্দ, তিনি তো মানুষ নন, কিন্তু তিনি মানুষ হয়ে আসেন। যেমন মল্লার কখনও রবিশঙ্করের সেতারে, কিম্বা কিশোরী আমোনকরের কণ্ঠে নেমে আসে, তেমন।
রামকৃষ্ণদেবের নতুন শাস্ত্র, মানবী শাস্ত্র। তিনি সব হয়েছেন বটে, তবে যেখানে "তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি", সেখানে তিনি বিশেষ করে হয়েছেন, আমার আনন্দের জন্য এসেছেন। গোটা জয়রামবাটি কেন, গোটা বিশ্বকেই ছাতিমতলা করে নিতে পারে যে ভালোবাসা, সে ভালোবাসাই মা সারদা। জয়রামবাটি কামারপুকুরের মাটি, যেখানে হেঁটেছেন, অপেক্ষা করেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন, কেঁদেছেন পুত্রহারা মায়ের সঙ্গে, হেসেছেন বাচ্চা মেয়েটির মত। বারবার বলেছেন, দোষের উপর দোষ সাজিয়ে চারদিকে পাঁচিল না তুলে দিতে। ভালোটা দেখতে, ভালোটা খুঁজতে, ভালোটা করতে। ভালো মানে কি? এই ধুলো।
মোহরদির বাড়ি ঘুরে এলাম। সেখানে একটা বড় কিছু করার পরিকল্পনা চলছে দেখে এলাম। ভালো লাগল। হারিয়ে যেতে দেবো কেন? "তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেব না"। মোহরদির বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় যুগ যুগ এখানেই তো দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই তো সেই ঝরণাতলা। যেখানে আজীবন বসে আছি। স্নাত হচ্ছি। প্রতিটা রোমকূপে প্রবেশ করে যাচ্ছে গীতবিতান। সঞ্জীবনী।
=======
সন্ধ্যায় এক বন্ধুর বাড়ি গেলাম। বোলপুর। ব্যস্ত শহর। এই প্রথম এলাম। কে বলবে এই প্রথম এলাম! যেন কতবার এসেছি। বন্ধু, আত্মীয়, সুহৃদ।
ফিরে আবার সেই শান্ত ডেরায়। নিঝুম চারদিক। শান্ত। খেয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। একটু হাঁটা যেতেই পারে। মন শান্ত বসন্তের পাতার মত বুকের উপর পড়ে। উদাসীন।
কি চাই? এমন কিছু যেখানে আমার মস্তিষ্ক আর হৃদয় দুই-ই এক হয়ে যায়। এমন এক দীঘি। যেখানে ডুবলে কোনো দ্বন্দ্ব নেই আর। যেখানে মস্তিষ্ক আর হৃদয় এক হয়ে যায় সেখানেই তো মুক্তি। অমৃত। আনন্দ। সেখানে যাই কিসে। কিভাবে?
রাত ভোর হল। সারাটা সকাল দাদার সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম। কথা শুনলাম। কাজ দেখলাম। কিভাবে ছবি, ছবি তোলার মানুষ এক হয়ে যায়, দেখলাম। গাছের পাতা, ফুল, সাঁওতাল মানুষ, বাচ্চা-বুড়ো সবার সঙ্গে আলাপ তাঁর। এমনকি জঙ্গলের বুকে গোপন কথার মত জেগে থাকা লাল দগদগে সূর্যশিশির অবধি তাঁর চোখ এড়ায় কই? দাদাকে প্রণাম জানিয়ে হোমস্টেতে ফিরলাম।
এবার ফিরব।
=======
ফেরার কোনো গল্প হয় না। তবু হয়ে যায় কখনও। মা তারা এক্সপ্রেস। ভিড় ভীষণ। রিজার্ভেশান নেই। দাঁড়ালাম কোনোরকমে। ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে বোলপুর।
হঠাৎ এক মহিলার চীৎকার শুনে ফিরে তাকালাম। বয়েস বছর পঁচিশেক হবে। কপালে অনেকের মত তারও তারাপীঠের সিঁদুর। সে চীৎকার করে বলছে, আমার মেয়ের মধ্যে মা তারা আছে… তোকে ঠিক দেখে নেবে…. ওকে কাড়বি!...
আমার সামনে বসে ছ'জন যুবক। তারা গত রাতে তারাপীঠে খাওয়া মদের আসরের গল্প বলছে। কে খেয়ে লাট হয়েছিল… কার হিসু দিয়ে এখনও মদ বেরোচ্ছে… এই সব আলোচনা, হাসি-মজা চলছে।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা একজন মাঝবয়েসী মানুষ। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি অবস্থা না?
দেখলাম তার কপালেও সিঁদুর। বললাম, আপনিও কি তারাপীঠ থেকে ফিরছেন?
উনি বললেন, হ্যাঁ, এই রটন্তী কালীপুজোতে আসি, সপরিবার।
দেখলাম একজন মহিলা আর একটা বাচ্চা বসে, ঘুমাচ্ছে।
বললাম, পরিবেশ?
মা যাকে যেমন রুচি দিয়েছেন…
মা তারা… একটু সরে দাঁড়াবেন?
সেই মহিলা। কানে ফোন। অনর্গল শাপশাপান্ত করতে করতে টয়লেটের দিকে এগোতে লাগলেন।
মনে মনে বললাম, এই ভালো, যা মনে থাকে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো… দিক শাপ…একদিন তো থামবে… অনেক শাপশাপান্ত, অভিযোগ, ষড়যন্ত্র করার পর কোথাও গিয়ে একজন মানুষ হয় তো ক্লান্ত হয়। থামে। বোঝে এ সব না করলেও হয় তো বা হত। ভালোই হত।
একজন বৃদ্ধ নাতিকে নিয়ে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এই ট্রেন কি নৈহাটি দিয়ে শিয়ালদা যাবে? ওখান থেকে হাওড়ার বাস পাব?
সে এসেছে বিহার থেকে। দূরে বৃদ্ধা স্ত্রী বসে। অসুস্থ। স্বপ্নে মা ডেকেছেন। ঠিক হয়ে যাবে মায়ের কাছে এলে। দুটো চোখে এত বিশ্বাস। এত যন্ত্রণা। বললাম, ডাক্তার দেখাচ্ছ? কি হয়েছে?
শুনে বুঝলাম, হাঁপানি। চিকিৎসা চলছে। বললাম, পুজো দেওয়া হল?
উদ্ভাসিত চোখে বলল, হাঁ দাদা।
মেয়েটা ফিরছে। চোখ মুছতে মুছতে। চোখের কাজল ঘেঁটে গেছে। সিঁদুর থেবড়ে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো। সবাই রাস্তা করে দিল।
সে সিটে এসে বসল। মাথাটা নীচু করে দিল। তার সারা শরীর কাঁপছে। ডবলু এপি সেভেন ইঞ্জিনের টানে না, কাঁপছে হৃদয় নামক বিচিত্র ইঞ্জিনের ধাক্কায়। মানুষের জীবনে হৃদয়ের চাইতে বেইমান আর কে আছে?
কখন বর্ধমান পেরিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। যুবকদের মধ্যে একজন ডেকে বলল, কাকু বসুন… অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে….
সে উঠে দাঁড়ালো। আমার সঙ্কোচ লাগল। তাকে দাঁড় করিয়ে বসব।
একটু জায়গা দেবেন?
দেখলাম একজন বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে। পরিপাটি সাজ। যত্ন করে টানা ভুরু।
সরে দাঁড়ালাম।
খুব স্মার্টলি বলল, ওটুকু জায়গায় তো হবে না….
ঠোঁটে হাসিটা দুষ্টুমির। কে হে তুমি, এমন বিব্রত করো! অগত্যা বসে পড়লাম। যুবককে ঠেলে সে তরুণী এগোতে এগোতে বলল, আসছি এখনি… জ্যাম করে রেখো না আবার….
ট্রেন ব্যাণ্ডেলে ঢুকবে। লম্বা লাইন তৈরি হয়ে গেল। সেই লাস্যময়ী তরুণী একটা বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে। তার সামনে একজন মহিলা। তার দিদিই মনে হল।
দিদি বলল, ঘুমিয়ে পড়ল? দেখবি?
সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ন্যাকামি কোরো না তো….. এটাও ন্যাকা হবে…. জামাইবাবু যেমন ছিল…..
তার দিদির মুখটা ফ্যাকাসে হল মুহূর্তে। যেন কি বলতে গিয়েও গিলে ফেলল।
ছিল?! ভালো করে তাকালাম। শাঁখাসিঁদুর তো নেই।
ট্রেন দাঁড়ালো। সবাই নামছে।
যে মেয়েটা খুব চেঁচাচ্ছিল, সেও একটা পিঠব্যাগ নিয়ে এগোচ্ছে। কি ক্লান্তি সে এগোনোতে।
ট্রেন ছাড়ল। বৃদ্ধ বিহারি এগিয়ে এসে বললেন, আমায় শিয়ালদার থেকে হাওড়ার বাসে তুলে দিবেন?
কিন্তু আমি তো নৈহাটি নেমে যাব।
সে বিহ্বল হয়ে তাকালো। ট্রেন ফাঁকা। সেই পায়জামা পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক এসে বললেন, আমি যাব… আমি তুলে দেব।
ট্রেন গঙ্গা পার হচ্ছে। চারদিক অন্ধকার নেমে আসছে। আমি জিজ্ঞাসা করছি গঙ্গাকে, কোথাও কি সান্ত্বনা আছে?
বৃদ্ধা ক্লান্ত মাথাটা বৃদ্ধের কাঁধে এলিয়ে। ঘুমাচ্ছেন। তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে নাতি। সেও ঘুমাচ্ছে। জেগে আছে বৃদ্ধ। ভালোবাসা।
এবার নামব আমি। ট্রেন নৈহাটি ঢুকল যে।