ভীষণ বহুশ্রুত বোকা বোকা একটা কথা লিখতে ইচ্ছা করল। এমনি এমনিই। আমি তো লিখে কাউকে ট্যাগ করি না সাধারণত, তাই আমার পোস্ট পড়তে কেউ বাধ্য নন, অনায়াসে এড়িয়েই যাওয়া যায়।
দীর্ঘদিন শিক্ষকতা আছে। খুব সামান্য কাজ করি। জন্মসূত্রে পাওয়া, নাকি অন্য কোনো কারণে জানি না, কিছু প্রাথমিক আদর্শে বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাসের অনুকূল যা কিছু গ্রহণ করি, প্রতিকূল যা বর্জন করি। খুব সামান্য কথা এগুলো।
যে কথাটা লেখার জন্য এই অনর্থক বকে যাওয়া সেটায় আসি। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ অবধি বিজ্ঞান পড়ানো আমার কাজ। কিন্তু ওই যে বললাম কয়েকটা প্রাথমিক আদর্শের উপর একটা আনুগত্য আছে। তার একদম প্রথমটা আমার কাছে সহমর্মিতা। কোনো বাচ্চার মধ্যে যদি সহমর্মিতা দেখি সে পড়াশোনায় ভীষণ ভালো না হলেও আমার ভালো লাগে। আবার যার মধ্যে ভীষণ চাতুরী, স্বার্থপরতা দেখি সে স্কুলের প্রথম দ্বিতীয় হলেও আমার মনে অতটা ছাপ ফেলে না। নানা বিষয়ে আগ্রহ, তর্ক, স্বাধীন চিন্তা, এ সব বাকি দিকগুলো, যা আমার ভালো লাগে। যার মধ্যে এ বোধ দেখি তাকেও ভালো লাগে।
কিন্তু, এখানে একটা বড় কিন্তু আছে। যখনই আমি কোনো অভিভাবককে বলি, পড়াশোনাটা হয়ে যাবে ধীরেসুস্থে, ওটা মেরেধরে অপমান করে হয় না, কিন্তু খুব ভালো ছেলে, কি মেয়ে আপনার। অনেক গুণ আছে।
তখন অনেকেই খুব স্থির সিদ্ধান্তে বলেন, দেখুন ও ভালো ছেলে, ভালো মেয়ে হয়ে কী হবে? যদি ভালো চাকরিই না পেল? যদি মাথা উঁচু করে বাঁচতেই না জানল একটা ভালো পোস্টে গিয়ে?
আমি আজ অবধি এর কোনো উত্তর কাউকে দিতে পারিনি। কারণ আমি এর উত্তর জানি না।
আজ যে সব মান্যবরেরা নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে, সেই সব ডাক্তার, পুলিশ, নেতামন্ত্রী, আরো অনেক অনেক ছোটোবড় পদাধিকারী মানুষেরা.... অনেকেই তো ভালো ছাত্র ছিলেন। তবে?
আসলে এই তবেটা একটা সঙ্কট। জীবনে ভালো নাম্বার, ভালো চাকরি, ভালো পোস্ট এসবের উপর দাবিদাওয়া থাকা খুব স্বাভাবিক। অন্তত সমাজের বর্তমান পরিকাঠামোতে। কিন্তু তারপর? যে মানুষ সহমর্মি নয়, সে তো গোটা জগতকে তার স্বার্থসিদ্ধির সরঞ্জাম হিসাবে দেখবেই। তাতে তার দোষ কী? সে যা যা পড়ে মুখস্থ করে ভালো নাম্বারের জন্য। সে যে বিদ্যায় পারঙ্গম হয় সেও নিজের শখ-আহ্লাদ-দাবিদাওয়া মিটিয়ে বেঁচে থাকার জন্য অর্থ উপার্জনের উপায় মাত্র। তার কাছে গোটা জগতই উপায়। উদ্দেশ্য এক - নিজের স্বার্থসিদ্ধি।
যিনি আমার বাড়ির সামনে বিকেলে উচ্চারণ করে গেলেন, ভালো হয়ে কী হবে, যদি ভালো চাকরি পাওয়ার যোগ্যই না হল সন্তান, তিনিই যখন রাতে কোনো জমায়েতে মোবাইলের আলো উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে জাস্টিস চাইছেন…. সৎ ডাক্তার, সৎ পুলিশ, সৎ শিক্ষক, সৎ প্রতিবেশী, সৎ পথচারী, সৎ নেতামন্ত্রী, সৎ ব্যবসাদার, সৎ উকিল, সৎ বিচারক, সৎ সাংবাদিক...... ইত্যাদি ইত্যাদি চাইছেন.... কোথাও একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে না?
ভালো হয়ে কী হবে, যদি উচ্চপদস্থই না হল…… এই ভাবনাটা ভীষণ ক্ষয়কারী। সব নষ্ট করে দেয়। সে-ই তখন ভাবে, ভালো হয়ে কী হবে যখন পদস্থ হয়েই গেছি। ভালো হয়ে কী হবে যখন আশেপাশে কেউ-ই ভালো থাকাটাকে খুব একটা বুদ্ধিমানতা বলে ধরে না। ভালো হয়ে কী হবে যদি নিজেকে বাঁচিয়ে আরো মাথা উঁচু করে হাঁটার মত আরো আরো টাকা জমিয়ে নিই অ-ভালো রাস্তায়। ভালো হয়ে কী হবে? ওটা তো বোকা লোকেদের সান্ত্বনা। ওটা লুজারদের আত্মগরিমার শেষ অবলম্বন। আমাদের তো দরকার নেই ভালো হওয়ার। ছোটোবেলা থেকেই তো মা বাবা শিখিয়েছেন, ভালো হয়ে কী হবে যদি না আমি অন্য কিছু হই?
আমাদের দেশে প্রায় সব কিছুই গ্র্যাণ্টেড বা সংস্কারবশত ধরে নেওয়ার চল আছে। এ জন্মের ব্যাখ্যা যে জাতি গতজন্মের সূত্রে খুঁজে এসেছে, কিম্বা জাতপাতের কৃত্রিম মানবচরিত্রের বিভাগে খুঁজে এসেছে সেখানে দায়িত্ববোধ একটা বড় বালাই। নৈতিক জীবন পূর্বজন্মের সংস্কার আর জন্মসূত্রে পাওয়া জাতপাতের বিচারে হয়। “ওদের জাতটাই তো ওরকম” ... ”কোন বংশে জন্মেছে দেখো”..... ”গতজন্মের অনেক সুকৃতি না থাকলে এমন স্বভাব হয়?”..... ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশ্চাত্য যখন মরাল সায়েন্স, মরাল শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করছি, আমরা তখন দৈব আর নকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে সব কিছুর সমাধান খুঁজে পাব আশা করছি। আমরা বলছি যত পাপ ঈশ্বরের নামে ধুয়ে যাবে, যত পাপ নির্দিষ্ট তিথিতে স্নানে ধুয়ে যাবে। যত পাপ বিশ্বাসে মিটে যাবে। এ সব আমাদের রক্তে ঢুকে গেছে। আমরা জানি শুধু বৈধ পথে স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই স্কুলকলেজ এর ব্যবস্থা। সে যদি কেউ নিজের মত করে অন্য পথে কেউ করে নিতে পারে সেখানেও আপত্তির তেমন কিছু নেই। যদি ধরা পড়ে যায় সে তার ভাগ্য, কোনো পূর্বজন্মের পাপের ফল।
সুতরাং সত্য বলো, সুপথে চলো - আমাদের প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়, অভিভাবকত্বে, সুদুর্লভ। সেখানে কার কাছে কী চাইছি? কিছু বোকা, সৎ, সাহসী লোক? যারা হিরো হওয়ার জন্য সামনে চলে আসবে? ধুস! সেও বা কদ্দিনের? গোড়ায় গলদ ঢুকে আছে দাদা, গোড়ায় গলদ, ভীষণ গলদ! ভালো হয়ে কী হবে? যদি টাকাপয়সা না হল, মায় হিরো হওয়াও না হল? বেকার সৎ হয়ে বাঁচতে যাব কেন দাদা?
দাওয়াই, সহমর্মিতা। সে শুধু আজকের এই জনগণ আবেগে না। প্রতিদিনের নিত্য জীবনচর্চায় যদি দায়িত্ব নিয়ে সে শিক্ষার চর্চা করা না গেল, সব বৃথা দাদা, সব বৃথা……