একদম ছোটোবেলায় শেখানো হত, পৃথিবী গোল। তারপর বলা হল, ঠিক গোল নয়, এদিক ওদিক তুবড়ানো। তো আমার মাইসোর স্যাণ্ডল সোপের ঠিক সেই অবস্থা। খোল থেকে বেরোলো যখন নিরীহ, শান্ত, গোলাকার একটা বস্তু। কিন্তু বর্তমানে তার পরিণত অবস্থার সঙ্গে শৈশবের কোনো মিলই নেই।
সাবানবিলাসী, সুগন্ধবিলাসী আমি কোনোদিন নই। কিন্তু উপহার না ব্যবহার করে কি ফেলে রাখা যায়?
কিন্তু প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাতেই বুঝলাম, এই গোলকটি যতটা নিরীহ দেখতে, ততটা নয়। সৌরভ ছড়ালেই যে নিরীহ হবে এমন কথা তো কোথাও লেখা নেই। আর লেখা থাকলেই যে সেটা ধ্রুব হবে এমনটাও নয়।
তো সেই সুগন্ধী গোলককে করতলাবদ্ধ করে, নিজেকে সূর্যের মত ভেবে প্রদক্ষিণ করাতে চাইছি। এ তো সংসারের আদি নিয়ম। কাউকে মুঠোর মধ্যে ভরে, নিজেকে কেন্দ্রে রেখে, নিজের চারপাশে ঘোরানো।
কিন্তু মানুষ চায় এক, আর হয় এক। যাকে হাতে ভালোবাসার ছলে বেঁধে রেখে নিজের চারদিকে ঘোরাতে চাই, সে যে সব সময়েই তা মেনে নেবে তাই বা হবে কেন?
ফলে ছিটকে ছিটকে সে মাটিতে পড়ল। যতবার পড়ে ততবার ধরে হাতে করে তুলি। মুঠোর মধ্যে ভরি। তার নির্যাসের এক বিন্দুও যেন আমার সেবা থেকে বঞ্চিত না হয় সে চেষ্টায় ব্যস্ত রাখছি নিজেকে। এ বেশ নিত্য খেলা হয়ে উঠছে। কত তাড়াতাড়ি তাকে বশে আনা যায়। যেদিন একবারও পড়ল না হাত থেকে সেদিন বিজয়ীর উৎসাহ নিয়ে বাইরে এলাম। আর যেদিন বার কয়েক পিছলে গিয়ে মাটিতে পড়ল, ততবার আমার সত্ত্বার কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত লাগল।
লড়াই নিত্য ঘটনা হয়ে উঠল। সে যত বলে, দাসত্ব শৃঙ্খল না পরিব পায় হে, না পরিব পায়… আমিও তত বলি, ভুলিও না, তুমি জন্ম হইতেই আমার সেবার জন্য বলিপ্রদত্ত।
এইভাবে চলতে চলতে তার চেহারা হয়ে উঠল দেখবার মত। সারা গা তুবড়ানো। বাধ্য হয়েও বাধ্য হচ্ছে না। কিন্তু ক্রমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে, যেন এই হল প্রতিবাদ। যেন বলছে, "কতদিন রাখবে? সবটুকু নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাকে মনে পড়বে, আমি কোনোদিন বাধ্য হইনি তোমার। যতবার পিছলে গেছি, যতবার তোমার বাঁধনের বাইরে এসে পড়েছি, ততবার তোমাকে নীচু হতে হয়েছে আমাকে আরো সজোরে বাঁধার জন্য। কিন্তু বারবার জিতে যাওয়ার এমনই নেশা তোমার যে খেয়ালই করোনি সেটা।"
যেমন সব খেলা একদিন শেষ হয়, এ খেলাও শেষ হল। শূন্য বাক্সটা পড়ে থাকল, যে চলে গেল তার সুগন্ধের রেশটুকু নিয়ে। কিন্তু সে সুগন্ধকে না বাঁধা যায়, না নিজের সেবায় লাগানো যায়।