মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়েই দেখল চাঁদের দুপাশে দুটো ডানা। নীল ডানা। সেই নীল ডানার নীল রঙ দিয়েই আকাশটা নীল। আর চাঁদের গা থেকে জোনাকির মত আলো বেরিয়ে বেরিয়ে হয়েছে তারা। এত তারা। আঙুলের কড়ে গোনা যায় না। এমনকি খাতাতেও লিখে শেষ করা যায় না।
সেঁজুতি ভাবল, এখনই ঘরে ঢুকবে না, আরো একটু উঠানে দাঁড়িয়ে থাকবে। এমনিতে তো ঠাকুমার বাড়ি আসাই হয় না। কি সুন্দর ঠাকুমার ছোট্টো বাড়িটা। সামনে বেড়া দেওয়া। বেড়ার ওপারে মাঠ। তারপর রাস্তা।
চাঁদের নীল ডানা দুটো যেন হাত। চাঁদ সেই ডানা ঝাপটিয়ে তাকে ডাকল। সেঁজুতি যায় কি করে? সেকি উড়তে পারে? কিন্তু কি তার মনে হল ফ্রকটাকে একটু ডানার মত করে নাড়িয়ে দেখল। কি আশ্চর্য, এক হাত উপরে উঠে গেল! তবে? চাঁদ আবার ইশারা করে ডাকল। সেঁজুতি ফ্রকটাকে বকের ডানার মত ঝাপটিয়ে ঝাপটিয়ে আকাশের দিকে উড়ে যেতে লাগল। নীচে বাড়িগুলো কি ছোটো ছোটো লাগছে। মা বাড়ির পিছনে কুয়োপাড়ে বসে আছে। মা কাঁদছে নিশ্চয়। বাবার চাকরি নেই। লকডাউনে চলে গেছে। ঠাকুমা পেনশান পায়। তাই ঠাকুমা বলেছে চলে আসতে। বাবা ওই জলের ট্যাঙ্কের নীচে যে ঘর ওখানে শুয়ে শুয়ে কিছু নিশ্চয় ভাবছে এখন। কি যে ভাবে বাবা, আর খালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অনেকটা ঊড়ে গেছে। এমন সময় একটা বড় সাদা মেঘ সেঁজুতিকে ঘিরে ধরল। মেঘের মধ্যে কি সুন্দর ছোটো ছোটো সব বাড়ি। সব বাড়ির রঙ সাদা। রাস্তা সাদা। মানুষগুলো কি ছোটো ছোটো, তারাও সব সাদা। একটা বুড়ো মানুষ হঠাৎ এগিয়ে এসে সেঁজুতির হাত ধরে বলল, এসো।
সেঁজুতি বুড়ো মানুষটার হাত ধরে মেঘের মধ্যে হাঁটতে শুরু করল। কেউ তার দিকে তাকিয়ে দেখছে না। সবাই নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। হাসাহাসি করছে। বাচ্চাগুলো দৌড়ঝাঁপ করছে। বুড়ো মানুষটা তাকে একটা মাঠে নিয়ে এলো। মাঠের সব ঘাসের রঙ সাদা। মাঝখানে একটা বড় সিংহাসন পাতা আছে, তার রঙও সাদা। সেই সিংহাসনে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা বসে আছে, তাদের পোশাক দেখে মনে হল এদেশের রাজারাণী হবে, তাদের গায়ের রঙ, পোশাক সব সাদা। বুড়ো মানুষটা বলল, মহারাজ, এই সেঁজুতি। আপনি ডেকেছিলেন।
সেঁজুতি কিছু বোঝার আগেই, একটা সাদা চেয়ার একজন সাদা বেঁটে লোক এনে দিয়ে বলল, বোসো। আরেকজন সাদা মগে করে একটা সাদা কিছু নিয়ে তাকে বলল, খাও।
সেঁজুতি রাজার দিকে তাকালো, রাণীর দিকে তাকালো। রাণী বলল, খেয়ে নাও, তারপর কথা হবে। রাণী যখন কথা বলল, রাণীর মুখ থেকে সাদা অল্প অল্প মেঘ বেরিয়ে এলো।
সেঁজুতি চুমুক দিল। কি দারুণ খেতে। মিষ্টি। এমন মিষ্টি তো সে কোনোদিন খায়নি।
তার খাওয়া শেষ হতে রাজা বলল, বলো, কি বলছিলে?
সেঁজুতি বলল, আমি? আমি আপনাকে তো কিছুই বলিনি কোনোদিন। আমি তো আপনাকে চিনিই না।
রাণী বলল, তবে তুমি রাতে উঠানে এসে কাঁদো কেন রোজ?
সেঁজুতি বলল, আমার বাবার যে কাজ চলে গেছে। ট্রেন বন্ধ। তাই বাবার কারখানা থেকে বাবাকে বসিয়ে দিয়েছে।
রাণী রাজার দিকে তাকালো। রাজা বলল, বুঝেছি। তুমি কি চাও, বাবার কাজটা হয়ে যাক তো? আচ্ছা, বাবাকে আসতে বোলো, আমরা একটা কাজ ঠিক করে দেব। সে রোজ এসে মেঘের মাটি কেটে দেবে আর আমরা তাকে একটা করে সোনার মুদ্রা দেব। ঠিক আছে?
সেঁজুতি বলল, আচ্ছা।
যখন সকাল হল, সেঁজুতি উঠে বিছানা থেকে নেমে বাবার ছবিটার সামনে দাঁড়ালো, তার মনটা আজকে এত কষ্ট পেল না। যেদিন এই স্বপ্নটা দেখে, সেদিন মনে হয় বাবা মেঘের রাজ্যে মাটি কেটে দিচ্ছে, আর বাবাকে একটা করে সোনার মুদ্রা দিচ্ছে মেঘের রাজা। বাবা কিছু সোনার মুদ্রা জমিয়েই চলে আসবে। তাকে একটা দামী মোবাইল কিনে দেবে, নইলে অনলাইন ক্লাস করবে কি করে? আর তাকে আবার আগের স্কুলটায় ভর্তি করে দেবে। আবার নতুন ইউনিফর্ম কিনে দেবে। স্কুলের প্রিন্সিপালের টেবিলের উপর টাকার মুদ্রার থলি রেখে বলবে, এই নাও টাকা, এবার সেঁজুতিকে দাও স্কুলে আসতে।