সব জিনিসের একটা সীমা থাকে তো। গোপাল সামন্ত রোজ কলকাতা ঠেঙিয়ে অফিস করে এসে চাট্টি ডালভাত খেয়ে রাতে শোবে, অমনি রাত একটা বাজলেই পড়ার ঘরে টুক করে টেবিল টানার শব্দ। মানে উনি এলেন। তারপর ঘস ঘস করে বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দ। মানে উনি পড়ছেন। আলো জ্বালতে লাগে না। এমনিই অন্ধকারে পাতার পর পাতা পড়ে যান। গোপাল সামন্তের মাথাটা গরম হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আবার খুক খুক করে হাসে। 'বিন্দুর ছেলে' পড়ে তো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্নার শব্দও পেয়েছে গোপাল সামন্ত বিছানায় কোলবালিশে ঠ্যাঙ তুলে শুয়ে শুয়ে।
সে আবার যাওয়ার আগে চিরকূটে লিখে রেখে যায়, 'মানিক', কি 'বিভূতি', কি 'তারাশঙ্কর', কি 'আগাথা ক্রিস্টি', কি 'গোগোল', কি 'কাম্যু'। গোপালকে শুতে যাওয়ার আগে সে সব বইগুলো সব রেখে যেতে হয় পড়ার টেবিলে। উনি নিজে আবার বইয়ের আলমারিতে হাত দেননা, সেটা নাকি ওনার নীতিবিরুদ্ধ। তাই গোপাল সামন্ত বার করে দেন, সে পড়ে।
এক একদিন কৌতুহল বশে গোপাল ঘরে এসে দেখেছে। ও বাবা, আলো জ্বাললেই সে হাওয়া। কিম্বা অন্ধকারে এলেও সে চেয়ার ঠেলে চলে যাবে। একদিন লিখে রাখল চিরকূটে, "আপনি আসবেন না, আমার লজ্জা লাগে"।
গোপাল সেই থেকে যায় না। কিন্তু একদিন হঠাৎ কেন জানি মনে হল তাকে ভালো মানুষ পেয়ে সে এক্সপ্লয়েট করছে নাকি এটা?
ব্যস, চিন্তাটা একদিন, দুদিন দানা বাঁধতে বাঁধতে সত্যিই একদিন দগদগে ফোঁড়ার মত হল। সে একটা ফন্দি আঁটল। রাতে শুতে যাওয়ার আগে দেখল চিরকুটে লেখা, 'সুনীলের কবিতা'। তো গোপাল সামন্ত করল কি, 'রামায়ণ'টা রেখে শুতে চলে গেল। নাও এবার বোঝো! বোকা ভেবে সবাই ঠকিয়েছে, মাথায় কাঁঠাল ভেঙেছে, তা বলে ভূতেও তাই করবে? হবে না।
সে এলো না। পর পর তিনদিন গেল, সে এলো না। কিন্তু গোপাল সামন্তের এবারে আরেক জ্বালা হল। সে আসছে না বলে তার ঘুম আসতে চাইল না। অফিসে গিয়ে কাজে মন বসে না। গোপাল সামন্ত একা মানুষ, তার এখন মনে হচ্ছে ভূত হোক যে-ই হোক, তবু তো কেউ থাকত!
গোপাল রাতে উঠে আলো জ্বেলে পড়ার টেবিলে বসে। এটা ওটা পড়ে। মন বসে না। ঘর অন্ধকার করে বসল একদিন। ও মা একি! গোপাল নিজেকে দেখে অবাক। সে কাঁদছে। হা কপাল, শেষে কিনা এক পড়ুয়া ভূতের জন্য কাঁদছে?! এই জন্যেই সবাই তার মাথায় কাঁঠাল ভাঙে! কাঁঠাল কেন শুধু গোটা কাঁঠালগাছটা ভাঙলেও বলার কিছু নেই। গোপাল কেঁদে কেঁদে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়ল। কোথায় খুঁজবে তাকে। একি মানুষ যে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে?
সকালে উঠে অবাক। তার হাতের নীচে চিরকূট চাপা। তাতে লেখা,"আপনি কাঁদবেন না। সরল মানুষেরা কাঁদলে আমার কান্না পায়। আপনি জানেন না, আমিও আপনার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে সারারাত কেঁদেছি, আপনার কান্না দেখে। আমি আজ রাতে আসব, আপনি সুনীলের কবিতা বার করে রাখবেন। আপনি ও ঘরে শোবেন। আমি জোরে জোরে পড়ব, আপনার ঘুম চলে আসবে।
আরেকটা কথা, আমি কিন্তু রামায়ণের ভয়ে আসিনি এ কদিন, তা নয়। রামে আমার ভয় নেই, আপনি চাননি আমি আসি, তাই আমি আসিনি। আর এও সত্যি, আমারও না এসে ভালো লাগেনি। মন খারাপ করেছে। ভালোবাসলে মন খারাপ করে। ভূত হলেও করে। ভালো থাকবেন।"