প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। রাজা ঘুমাচ্ছেন। ভোরবেলা। যদিও আলো ফোটেনি। তা ফুটবেই বা কী করে, এতো মেঘ। এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়ালো একজন আগন্তুক।
প্রহরী বলল, কাকে চাই?
সে বলল, রাজার দরজায় এসেছি কী কসাইকে খুঁজতে, না পুরুতকে, রাজাকে চাই... কী আহাম্মক হে তুমি!
প্রহরী বলল, তিনি ঘুমাচ্ছেন।
আগন্তুক বলল, ডাকো গিয়ে। নইলে ক্ষতি তেনারই।
প্রহরী বলল, কীরকম? তুমি কী ওঝা? তুমি কী টের পেয়েছ আজ রাতে রাজামশায়কে সাপে কাটবে, তুমি ঝাড়ফুঁক করবে?... যত্তসব.. কী দাবী....
আগন্তুক পকেট থেকে একটা রঙিন কাগজ বের করে বলল, এ কাগজ তোমরাই ছাপিয়েছিলে তো?
প্রহরী বলল, হ্যাঁ.... রাজ্যের কোষাগার সামলানোর জন্য একজন সৎ লোক চাই.... এ তো আমাদেরই বিজ্ঞাপন....
আগন্তুক বলল, আমিই সেই.... আমার মত সৎ.....
প্রহরী তার কথা থামিয়ে বলল, ও আমাদের ঢের ঢের দেখা আছে.... কেমন সৎ জানা আছে.... সব ন্যাকা.....
আগন্তুক বলল, এমন বুদ্ধি না হলে প্রহরী হয়? বলি সৎ কাকে বলে শুনি?
প্রহরী বলল, জ্বালালে দেখছি.... যে নেশা করে না, ঘুষ খায় না, মিথ্যাকথা বলে না, পাপকাজ করে না.... কাউকে ঠকায় না.......
আগন্তুক বলল, এটা করে না, সেটা করে না.... বাহ বাহ... মানে সোজা কথায় একটা আদ্যোপান্ত বোকা লোক চাইছ.... এই তো? তা সেটা না লিখে এমন বেঁকিয়ে চুরিয়ে লিখেছ কেন হে বাপু?
প্রহরী গেল চোটে। বলল, মামদোবাজি পেয়েছ? সৎ মানে বোকা? আমাদের মহারাজা কেমন সৎ.... উনি বোকা? আমি, এই যে আমি। কী ভীষণ সৎ.... আমি বোকা?
আগন্তুক বলল, তোমরা বোকা হবে কেন, তোমরা অহংকারী.... সত্যের অহংকারী.... চোর যে নিষ্ঠা নিয়ে চুরি করে, খুনী যে সুকৌশলে খুন করে...সে সবের প্রশংসা করতে শুনেছ কোনোদিন কাউকে? তেমন অহংকারী মানুষের সততা..... ওতে কোনো ধার নেই... শুধু ওজন... বড্ড ভারী... .তোমরা যে অর্থে সৎ সে অর্থের সৎ লোক চাইলে কি আর বিজ্ঞাপন দিতে?
প্রহরী বলল, তোমার কথায় কোনো যুক্তি নেই..... তুমি নরম মনের সৎ মানুষ খুঁজছ.... তেমন মানুষ দেখেছ অ্যাদ্দিনে? ভীতুগুলো শুধু অমন ল্যাড়বেড়ে সৎ হয়.... ও দিয়ে কাজ চলে?
আগন্তুক বলল, তুমিই বা শক্তিশালী সৎ মানুষ দেখেছ আজ অবধি? লোভ নেই, স্বার্থবুদ্ধি নেই, অথচ বেজায় মেধাবী, তায় আবার সৎ? দেখেছ?
প্রহরী বলল, না, সেও বটে। স্বার্থবুদ্ধিহীন, বুদ্ধিমান সৎ মানুষ বলে কিছু দেখিনি অবশ্য..... কিন্তু আছে তো কোথাও.....
আগন্তুক বলল, বোকা সাজছ? আসলে তোমরা যে জাতের বোকা লোক চাচ্ছ.... তেমন পাওয়া ভার আজকাল..... দেখো বুদ্ধিমান সৎ মানুষ ভরসা জুগিয়ে বোকা বানায়, আর বুদ্ধিমান অসৎ মানুষ লোভ জাগিয়ে বোকা বানায়.... বোকা তো দুপক্ষই বানায়.... বানায় না? মানুষের জগৎ আর কী? বোকা বনা আর বোকা বানানোর কল….চলছে তো চলছেই…. .কখনও তুমি শিকার…কখনও তুমি শিকারী….. এ কথা তো স্বীকার করবে?
প্রহরী চুপ করে থাকল। ভাবল কিছু। তারপর বলল, তা তুমি কেমন জাতের সৎ? সেটা ব্যাখ্যা করো দেখি…. যদি মনে ধরে আমার, আমি এক্ষুনি তোমায় রাজার কাছে নিয়ে যাচ্ছি…. আর যদি না ধরে…. তবে হুড়কো দিয়ে নগরের বাইরে বার করে দিয়ে আসব…. বলো…. তা তুমি কী ধরণের সৎ?
আগন্তুক বলল, আমি বুদ্ধিমান। আমি একা খাই না। আবার সবাইকে দিয়েও খাই না। আমি গোষ্ঠী বুঝি। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বুঝি। গোষ্ঠীতন্ত্রও বুঝি। কোন গোষ্ঠীকে কতটা খাইয়ে, কোন গোষ্ঠীকে আধপেটা খাইয়ে, কোন গোষ্ঠীকে উস্কিয়ে, কোন গোষ্ঠীকে শান্ত রেখে সমাজ চালাতে হয় আমার নখদর্পণে। আমার সততাই আমার সম্পদ হে ভায়া। আমার পুঁজি। কখন তাকে দেখাতে হয়, আর কখন তাকে ঢাকতে হয় আমি জানি। মানুষ অসুস্থ হলে ভালো চিকিৎসক খোঁজে, খিদে পেলে ভালো খাবারের দোকান, চুল বাড়লে ভালো নাপিত, কাপড় ছিঁড়লে ভালো দর্জি, দূরে যেতে হলে ভালো চালক, গোপন ধন আগলাতে গেলে বিশ্বস্ত মানুষ, বাড়ি বানাতে গেলে ভালো ঘরামী, শ্রাদ্ধশান্তি করতে গেলে ভালো পুরুত….. ইত্যাদি ইত্যাদি। ভালো ছেড়ে সৎ কখন খোঁজে বলো তো? যখন ওই গোষ্ঠী কোন্দলে আঠা শুকিয়ে যায়, ঘর্ষণে খড়খড় আওয়াজ হয়। তখন আবার একজন মানুষ খোঁজে যে তেলের কাজ করবে। ঘর্ষণ থাকবে, কিন্তু ঘর্ষণজনিত তাপ উৎপন্ন হবে না আর শব্দকে বাইরে আসতে দেবে না। অনেকটা ওই নীলকণ্ঠের মত। সবাই সৎ মানুষ বলতে ওই নীলকন্ঠ একজনকে খোঁজে। আমি তেমন মানুষ। তেমন সৎ মানুষ। কারণ আমার অসততা কখনও আমাকে সত্যের অহংকারী হতে দেয় না, তাই আমি সত্যের মর্যাদা শুধু ফলে-ফুলে সাজিয়ে রাখি…. শিকড়ে চারিয়ে দিই না….. সেখানে শুধু আমার বুদ্ধিই বলবান…. সত্যও না, অসত্যও না…..
প্রহরী দরজা খুলে দিল।