Skip to main content
 
  "কেতু তো পাগল করে দিচ্ছে, বুঝলেন মিত্তির মশায়। এবার পুজোয় ওর সাথে ব্যাঙ্গালোরেই থাকতে হবে। সে শুনবেই না। আচ্ছা বলেন এই বাহাত্তর বছর বয়সে শরীরে এত ধকল সয়। তাছাড়া গিন্নীরও তো যা শরীরের অবস্থা!", নিবারণবাবু যাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন, শুধু তিনি নন, আরো পাঁচ-ছয় জন নিবারণবাবুর বয়সী বৃদ্ধ তাঁর শ্রোতা। এই বিকাল ৫টা নাগাদ কোন্নগর স্টেশানের এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মের কোণে রোজ বসেন এনারা।
      নিবারণবাবু নিঃসন্তান। বৌদি অকালে গত হওয়ায় দাদার ছেলেটাকেই, মানে কেতু ওরফে কুশলকে নিবারণবাবু ও ওনার স্ত্রী পুত্রস্নেহে মানুষ করেন। এখন কুশল ব্যাঙ্গালোরে একটা MNC-তে ভাল কাজ করে। নিবারণবাবু খুব কষ্ট করেই বড় করেন কুশলকে। একটা জুটমিলের ছোটবাবু ছিলেন। আর ওনার দাদা বাড়ির সামনেই একটা মুদিখানার দোকান চালাতেন। চলত না বললেই চলে। উনি গত হয়েছেন বছর পাঁচেক হল।
      "তুমি ভাগ্যবান নিবারণ। আমার তো নিজের ছেলেদুটোই আমায় পোঁছে না। মনে হয় না আর ফিরবে এ দেশে। মুখাগ্নি করতে আসবে কিনাও সন্দেহ।" মিত্তিরবাবু বললেন।
      নিবারণবাবুর মুখে বেশ একটা আত্মতৃপ্তির হাসি দেখা গেল। মুখে বললেন," তা ঠিকই বলেছ মিত্তির, কেতুর মত ছেলে আজকালকার দিনে খুবই দুর্লভ।" সকলেই একবাক্যে মাথা নাড়লেন।
"আরে আমার যে জমানো টাকাগুলো, ওতো অমনিই পড়ে আছে। ও একমাসেই যা টাকা পাঠায় তাতে প্রায় দু'মাস হেসেখেলে চলে যায়। আমি বলি আরে এতটাকা দিয়ে কি হবে? তা বলে, এতদিন তো অনেক কষ্ট করলে। এবারে একটু জীবনটাকে ভোগ করো কাকা। তুমি ছাড়া আর কে আছে বলো আমার। কার জন্য করব? বাবা তো থেকেও ছিলেন না, আর মাকে তো আমার মনেই পড়ে না।" বলতে বলতে নিবারণবাবুর চোখ ভরে এল, গলা বুজে আসল।
      আরো কয়েকজন বৃদ্ধও, 'আহা আহা' করে উঠলেন। নিবারণবাবু আরো বললেন, "আরে ওর কাকির চিকিৎসা তো ও এখানে কিছুতেই করতে দেবে না, বলে পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসা আছে নাকি! শোনো কথা! তা এখানে লোক বেঁচে আছে কি করে! আর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা তো ওই করে ওখান থেকে। ওর সব বন্ধু ডাক্তারদের বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করানো, কেমোর টাকা পাঠানো সব।"
 
     নিবারণবাবু বাড়ি ফেরেন রাত্তির ১০টা নাগাদ। পাড়ার দুটো ছেলেকে টিউশান পড়িয়ে, ফিরে রাত্তিরের রান্না চাপান। তারপর রমাদেবীর খাটের পাশে এসে বসেন। রমাদেবীর কথা বন্ধ আজ পাঁচ-ছয় মাস হল। গলায় ক্যান্সার। রমাদেবী ইশারায় জিজ্ঞাসা করেন, কেতু ফোন করেছিল? নিবারণবাবু নিরুত্তর থাকেন। তাঁর চোখ ফেটে জল আসে। তবু হেসে বলেন, "করবে। সময় পেলেই করবে।" প্রায় দু'মাস হল সে ফোন করে নি। আজকাল এরকমই হয়। অনেকবার চিঠি লিখেছেন, ওর একটা ছোটবেলার বন্ধুকে দিয়ে ই-মেলও করিয়েছেন, যদি কিছু টাকা পাঠায়। রোজ নিবারণবাবু পোস্ট অফিসে গিয়ে সকালবেলাটায় বসে থাকেন, যদি আজ টাকা আসে, ওষুধগুলো অন্তত কিনতে পারবেন রমার!

(ছবিঃ সুমন দাস)