Skip to main content

     আমরা বন্ধুরা পুরী থেকে ফিরছি। রাত আটটার ডাউন পুরী হাওড়া এক্সপ্রেস। বেশ কিছুটা আগেই স্টেশানে পৌঁছে গেছি। ট্রেন দেওয়াই ছিল প্ল্যাটফর্মে। কামরায় উঠতেই আমরা অবাক। আমাদের সিটে বসে একজন বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে, শতচ্ছিন্ন পোশাক, উশকোখুশকো চুল। আচরণে বুঝলাম মানসিক ভারসাম্যহীন। কি করি, অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। ইতিমধ্যে আমরা প্যাকিং খাবারগুলো উপরের বার্থে সাজিয়ে রাখছি। মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হল, বকা হল। সে অনড়। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকায় আর, না না বলতে থাকে। মহা ফ্যাসাদ! হঠাৎ খাবারগুলোর দিকে তাকাল। বিস্ফারিত, ক্ষুধার্ত চোখ। বলল,"বিরিয়ানি?" ওতে রুটি আর মাংস প্যাক করা ছিল। বললাম "না, বিরিয়ানি না।" সে কোন কথা শুনবার বা দমবার পাত্রী না। ছটফট করতে শুরু করল। হিসাবের প্যাকেট। কি করি। অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে আমরা একটা প্যাকেট ওকে দিয়ে দিলাম। "বিরিয়ানি!" বলে একগাল হেসে খাবারটা বুকে করে নেমে গেল। আমি আবার যাতে না উঠে আসে দেখবার জন্য দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম উল্টো দিকের একটা অন্ধকার ফাঁকা ট্রেনে উঠতে গেল। কি মনে করে আবার ফিরে আমার সামনে দাঁড়াল। চোখ ভর্তি জল উপচে গাল বেয়ে পড়ছে। হেসে বলল, "অনেকদিন খাইনি বিরিয়ানি। গন্ধটা চিনি। ও নিতে আসবে আমায়। বলে গেছে এই স্টেশানে অপেক্ষা করতে..."

     আমি নির্বাক। "কে আসবে নিতে?" জিজ্ঞাসা করলাম। ওর মুখটা সাথে সাথেই কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শূন্যদৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে করার চেষ্টা করল কয়েকবার। তারপর দু'তিন বার বলল, "আসবে আসবে।" বলতে বলতে মুখের মধ্যে জমল একজন্ম কান্না। ছুটে সামনের অন্ধকার কামরায় মিলিয়ে গেল।

 

     আমাদের ট্রেন ছাড়ল। জানি না কিসে ওকে পাগল করেছে- অপেক্ষা না বিশ্বাসঘাতকতা। সে নিজেকে ভুলেছে, তার ভালবাসার মানুষটার পরিচয় ভুলেছে, ভুলতে পারেনি অপেক্ষাটা। বার বার ওর হাসিটা মনে ভাসছিল। দু'চোখের জলের ধারার মাঝে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তা বোধহয় ও স্বাভাবিক নয় বলেই।

     সারা কামরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কামরার ভিতরে জানলা দিয়ে ছিটকে আসা চকিত আলো, ট্রেনের রাতের বুক চেরা ধাতব ছন্দময় গতি আমার ঘুমহারা মনকে উদ্বেল করে তুলল। কত জীবন এভাবে কক্ষচ্যুত হয়ে ছিটকে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব কি হারিয়ে যায়? জানি না, তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, না হারায় না। এত বড় সংসার শুধুই ফাঁকিকে পাথেয় করে চলতে পারে না। সেই বিশ্বাসেই কালকের সকালের অপেক্ষা। ট্রেনের হুইসেলও যেন তাই ঘোষণা করল রাতের বুক চিরে- চরৈবেতি চরৈবেতি..

 


     মনটা শান্ত হল।