সৌরভ ভট্টাচার্য
14 November 2017
সত্যি বলতে আমি জানতাম না। আমার কোনো ধারণাই ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, সকালে কি
করো? বলল, সকালে বাড়ি গিয়ে রান্না চাপাই, ঘরের কাজ করি। তারপর সেন্টারের দিদিরা
অন্য কোথাও পাঠালে যাই।
- কিসের কাজে?
- কেন? আয়ার কাজে। খুব বয়স্ক পেশেন্ট হলে দুপুরের স্নান-খাওয়ানোর জন্যে যাই।
- ঘুম?
- এই যে এখানে যতটুকু হয়।
এ তো গেল একরকম। কারোর কারোর রাত আটটা থেকে সকাল আটটা করে আবার
পরের দিন অন্য কোথাও সকাল আটটা থেকে রাত আটটা।
- ঘরে যাও না?
- না।
- কেন?
- কি হবে? ছেলে তো বাইরে কাজ করে। মানুষ বলতে তো আমি আর ওই ছেলে। কার জন্য ফেরা?
বিধবা, সংসারের কোনো পিছুটান নেই, বা সে অর্থে তেমন কোনো ঘরের
দায়িত্ব নেই, তারা চব্বিশ ঘন্টাই আয়া।
বাইশ
বছরের মেয়ে থেকে পঞ্চাশ বছরের বয়স্কা। কেউ বিধবা, কেউ স্বামী পরিত্যক্তা, কারোর
স্বামী অমানুষ, কারোর ঘাড়ে সংসারের জোয়াল, কেউ বা স্বামীর উপার্জনে সংসার চালাতে
পারে না।
বাবা অসুস্থ না হলে, সমাজের এইদিকটা আমার চোখে কোনোদিন পড়ত না
হয়ত। খুব নিষ্ঠুর হলেও কথাটা তো সত্যি, আয়ার কাজ মানে একটা সম্মানহীন যেমন তেমন
কাজ। যদিও তাদেরই সেবায় বাবা অনেকটা সুস্থের দিকে, এও সত্যি। আয়া কোনো বিশেষ কলে
গড়া যন্ত্র নয় যে সকলের ব্যবহার, নিষ্ঠা সমান হবে। তারতম্য তো আছেই। থাকতেই হবে।
কিন্তু হরেদরে খারাপ মানুষ আর ক'টা দেখলাম। দেখিনি তো। চুরি হয়েছে। নিজে সজাগ
হয়েছি। কিছু বলতে বেধেছে। চুরি বন্ধ হয়েছে। সারাদিন না ঘুমিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করেও
যাদের সংসারের চাকার কর্কশ আওয়াজ থামতে চায় না, তখন তাদের চুলচেরা নীতির বিচার
করতে বিবেকে বেধেছে। আমায় তো কোনদিন ওই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। বিচার করব কোন
বিধানে? চুরিকে সমর্থন করছি না, নিজের অপারগতার কথা বলছি মাত্র।
এ সমাজ নাকি পুরুষতান্ত্রিক। নাকি কেন? নিশ্চয় পুরুষতান্ত্রিক।
পুরুষ অনেক সংসারে কেন, বেশিরভাগ সংসারেই শেষ কথা বলে। তবে এরা কারা? কোন সংসারের?
যাদের সকাল বিকাল না বেরোলে বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না, তারা কোন তন্ত্র চালিয়ে নিয়ে
যাচ্ছে? মানবতন্ত্র কি পুরুষতন্ত্রের চাইতে বড় শব্দ? মধ্যবিত্ত, শিক্ষিতা
কর্মরতাদের কথা বলছি না। তাদের তবু খানিক খোলা আকাশ আছে। লড়াইয়ের মানে সেখানে
স্পষ্ট না হলেও তার একটা অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এরা? হাস্পাতালে, নার্সিংহোমে,
বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা এই অশিক্ষিতা, বা নামমাত্র শিক্ষিতা মেয়েরা, বউরা? এরা কোন
তন্ত্রের অধিকারী?
বাবা
হয়ত আয়াকে দু-তিন বার ডেকে রাতে সাড়া পাচ্ছেন না, আমি শুনতে পেয়ে যখন আয়াকে বকাবকি
করার জন্য দোতলায় উঠেছি, দেখেছি দুটো শুকনো রুটী নামমাত্র তরকারি কিম্বা ডালে
ডুবিয়ে কোণের ঘরে সেঁধিয়ে বসে, অত্যন্ত সংকোচের সাথে, ডান হাতে সবেমাত্র একটা
গ্রাস নিয়েছে, মুখেরটা চিবোচ্ছে, উদাস শূন্যদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে। সামনে দেওয়াল।
বড়লোকেদের বাড়ির দেওয়াল। দেওয়ালে চোখ আটকে কিসের হিসাব মেলাচ্ছে সেই জানে। কোন
হিসাবটাই বা মিলেছে তার? খাওয়া হল কি হল না খোঁজ নেওয়ার মানুষ সংসারে কই তার? এই
খাওয়ার সময়টাও তো তার বাড়তি। কাজের জন্যে আসা, সে পয়সা পাচ্ছে তার জন্যেই তো, না
হাত-পা ছড়িয়ে খাওয়ার জন্য? তবে চোরের মত লুকিয়ে খেয়ে নিতে হবে না? যাতে বাড়ির
লোকজন টের না পায় সেও মানুষ, তারও খিদেতেষ্টা আছে। আয়াদের কেন, আমাদের সমাজের অনেক
মানুষের নিজের মানুষ হওয়ার মত বালাই খুব কম আছে।
বকাবকি
হল না। তার ওই ফ্যালফ্যালে শূন্য চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারিনি। তার অপরাধীর
মত মুখ আমার বিবেক পুড়িয়েছে। তার ঘুম ধরে আসা চোখে, তার ঝিমুনি লাগা অবাধ্য শরীরের
দাবীকে, অনাবশ্যক উৎপাত মনে করে ফাঁসির আসামীর মত মুখে বলা, “একটু চোখটা লেগে
গিয়েছিল দাদা” – কথাটা তীরের ফলার মত বিঁধেছে।
রাতে
ছাদের দরজায় শিকল পড়েছে কিনা যখন দেখতে উঠেছি, কারোর কারোর আশঙ্কার চোখও দেখেছি।
পরে জেনেছি, প্রয়োজন হলে অনেকের খাদক হতেও তাদের হয়। “পেটের জন্যে কত যে কি করতে
হয় দাদা! এসব কাকে বলবেন? সেন্টারের দিদিরা বলবে অত সতীপনা নিয়ে এসব কাজ হয় না। সব
মানুষ তো আর সমান হয় না। কারোর কারোর খিদে বেশি। তো? বাজারে তো তার থেকে বাঁচারও
উপায় বেরিয়েছে, বেরোয়নি? কি বলবেন দাদা?”
কিচ্ছু
বলব না। বলার কথা তো আমার নয়। বলার কথা তো নয়। এ পাপের ভাগীদার হওয়া শুধু।
প্রত্যেকের। সমাজটা তো আমাকে বাদ দিয়ে নয়। ক'দিন আগে যখন মেঘালয় বেড়াতে বেরোলাম,
বাবাকে প্রণাম করে, টাটা করে বেরোচ্ছি; সেই অবাঙালী আয়া বলল, দাঁড়ান দাদা।
দাঁড়ালাম। সে হাঁটুগেড়ে বসে দুটো হাত আমার পায়ের পাতায় রেখে, নিজের কপালে ছুঁইয়ে
বলল, সাবধানে ঘুরে আসুন দাদা।
আমার চোখ জ্বালা করল। কোনোরকমে তাকে হাসিমুখে 'আচ্ছা' বলে, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে
নামতে ভাবছিলাম, ও কিসের জোরে এমনভাবে প্রণাম করল - কৃতজ্ঞতায়, নাকি শ্রদ্ধায়?
উত্তর পেলাম ফিরে আসার পর। সে বলল, রাখীতে আমি যেখানেই থাকি দাদা, আমি আপনাকে রাখী
পরাতে আসবই দেখো। বুঝলাম সে আত্মীয়তার যোগসূত্রটা খুঁজে পেয়েছে।আমার সামনে এরা এক
একজন নতুন মানুষ। মানুষ শাসনটা সানন্দে নেয় সে অধিকার অর্জন করলে, কিন্তু অপমানটা
নয়।
-
কি পাশ?
- উচ্চমাধ্যমিকটা দেওয়া হয়নি। ইলেভেন অবধি পড়েছি।
- কেন?
- বিয়ে করে নিলাম।
- সে কি করে?
- অ্যামাজনের কুরিয়ার।
তাকে
বোঝালাম বেশ করে, তুই উচ্চমাধ্যমিকটা দে, এই তো বাইশ বছর বয়েস। কেন জীবনটা নষ্ট
করছিস?
বুঝল।
কত খরচ শুনল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা গ্র্যাজুয়েশান করতে কত পড়ে?
বললাম।
'আচ্ছা' বলে সে প্রসঙ্গে ইতি টানল।
পরের
দিন বাড়িতে এসেই আমার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াল। একটা কথা বলব?
- বল।
- বলছিলাম, আমি ওকে বলে ওর গ্র্যাজুয়েশনটা করানোর ব্যবস্থা করি বুঝলে। টাকার অভাবে
ও লাস্ট ইয়ারটা পড়তে পারেনি। তুমি ব্যবস্থা করবে? আমি আমার থেকে টাকা দিয়ে ওকে
করিয়ে নেব। ওর খুব ইচ্ছা জানো তো, কিন্তু ওই যে বললাম, অভাবে..
গলা বুজে আসাটা সামলে নিয়ে উপরে উঠে গেল ছুটে। আমার বাস্তবজ্ঞান একটা মরুঝড়ে উড়ে
গেল। এটা কি তন্ত্র? পুরুষ?
এক দরিদ্রা রমণী। এক মঠের পরিচারিকার কাজ করেন, দু'বছরে যার
দুটোর বেশি শাড়ি দেখিনি, যা শতচ্ছিন্ন। বয়েস ষাটের উপর। একদিন সন্ধ্যায় আমার পথ
আগলে দাঁড়ালেন।
- একটা কথা বলব আপনাকে? অত্যন্ত সংকোচ চোখেমুখে। তবু মুখের কোণায় একটা প্রাণভোলানো
হাসি।
- বলুন।
- এবার আপনি মনটা স্থির করেন। একটা বিয়ে করেন। আপনার জন্য আমার বড্ড চিন্তা হয়। কে
দেখবে আপনাকে? মঙ্গলময়ের কাছে প্রার্থনা করেন, তিনি ঠিক জোগাড় করে দেবেন।
আমার
উত্তর নেই। একজন মানুষ, যার হারানোর মত সম্বলটুকু তার মঙ্গলময় বিধাতা তার জন্য জোগাড়
করতে পারেননি, সেই রমণী আমার ভবিষ্যতের জন্য চিন্তিতা!
পুরুষতন্ত্রটা
কি আসলে তবে? একটা ঢাল? শান্ত প্রকৃতির অঙ্কে লালিত একটা স্বপ্ন, যা মুহূর্তে
চুরমার হয়ে যেতে পারে প্রকৃতি তার ধৈর্য, স্থৈর্য হারালে? হ্যাঁ তাই। ধারকের
অস্তিত্ব অহংকারে নয়, ধারকত্বেই। এটা যত শীঘ্র বোঝা যায় ততই মঙ্গল। নইলে এ অপমানের
ভার চোকাতে একেকটা সভ্যতাকে কম মূল্য দিতে হয়নি, না জানি আরো কত মূল্য দিতে হবে
ভবিষ্যতই জানে।