Skip to main content

 

বিদ্যাসাগর এক ধনী মানুষের বাড়িতে বসে গল্প করছিলেন। এমন সময় এক ভিখারি আসে। গৃহকর্তা অপমান করে তাকে তাড়িয়ে দেন।

বিদ্যাসাগর, "আসছি" বলে উঠে যান। দৌড়ে গিয়ে রাস্তায় সেই ভিখারিকে ধরেন, তাকে বলেন, তোকে একটা টাকা দিতে পারি, তুই যদি ওই বাড়ি আর যাবি না কথা দিতে পারিস!

রবীন্দ্রনাথ যে গাড়িতে উঠছেন পাহাড়ে, সেই গাড়ির চালক কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে পিছনে আসা গাড়ি থেকে একজন নেমে বলেন, আপনি এ গাড়িতে চলে আসুন।

রবীন্দ্রনাথ আসেননি। কারণ ওতে ওই ড্রাইভারের অপমান হয়।

এমন অজস্র ছোটো ছোটো ঘটনার স্মৃতি আমাদের আছে।

বড় মানুষ অন্যের তুচ্ছতম অপমানও সহ্য করতে পারেন না। নিজের পর্বতসদৃশ অপমান হজম করে যান। এইটুকুতেই ওঁদের সঙ্গে সাধারণের যা পার্থক্য। বড় মানুষেরা বারবার দেখান, তুচ্ছ অপমান বলে কিছু নেই, যদি সেটা অন্যের সঙ্গে আমার সামনে করা হয়।

আমাদের সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে, জ্যান্ত একজন মানুষকে যাতে চিতায় পুড়িয়ে না ফেলা হয় সেটা নিয়ে শাস্ত্রের প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে কোর্টকাছারি করতে হয়। একজন বাল্যবিধবার বাঁচার অধিকারের জন্য শাস্ত্রমন্থন করে প্রাণপাত করতে হয়। এত এত অতিচেষ্টা করতে হয় সবার বোধগম্য এক সাধারণ মানবিক অধিকারকে কায়েম করতে। ওদেশে যেমন সাদাকালোর বৈষম্য নিয়ে কিং-এর আত্মবলিদান। অন্যান্য প্রাণীর ইতিহাস অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামের ইতিহাস কেবল। মানুষ ইতিহাস ক্ষমতার শুধু নয়, আত্মসম্মানের জন্যও সংগ্রামের ইতিহাস।

আমাদের সমাজে এ অপমান অহরহ ঘটে। সেই স্কুলজীবন থেকে শুরু হয়। 'শিক্ষকতা' আর 'মাষ্টারি'র মধ্যে যেন একটা বিশাল পার্থক্য আছে। শিক্ষকতা যে উদারতা, সহনশীলতা, সাম্যের উপর দাঁড়ায়, মাষ্টারি দাঁড়ায় না। সে এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে, 'কাজ আদায় করে'। 'মার্ক্স আর্নিং' সেখানে মুখ্য, 'লার্নিং বাইপ্রোডাক্ট'। কথায় কথায় তুলনা, অপমান। বাবা-মায়ের ক্ষোভ, ক্ষোভজাত আক্রোশ। সে যে কী ভয়ংকর জায়গায় পৌঁছাতে পারে সে যার অভিজ্ঞতা আছে সেই জানে।

যে কোনো প্রতিযোগিতা মানুষকে কিছুটা হলেও অসংবেদনশীল করে তোলে। আর সেখানে প্রতিযোগিতা যখন ভীষণ অস্বাস্থ্যকর জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে লাভ-ক্ষতি ছাড়া নীতি নির্ণায়ক আর কোনো ম্যাক্সিম নেই, সেখানে তো ব্যাপারটা আরো হতাশাজনক। জন ডুইয়ের মত প্র‍্যাগমাটিজিম দর্শনের প্রবক্তাও শিক্ষাকে এমন সঙ্কীর্ণ অর্থ করেননি প্রয়োগবাদের।

কিন্তু আমাদের অভ্যাস আছে ছোটো-ছোটো অপমানকে অগ্রাহ্য করার। যে সভ্যতা যত উন্নত সে ব্যক্তিবিশেষের মানরক্ষাতে তত সংবেদনশীল আর তৎপর। সে সভ্যতা একটা শিশুর বেড়ে ওঠার সময় তার মানসিক বিকাশ যাতে কোনোভাবে কোনো বিরূপ সমালোচনা, নিন্দা বা অতিশাসনে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে নিয়ে সজাগ। সে দেশে আইনও আছে সে নিয়ে যা আমাদের কাছে 'বাড়াবাড়ি'।

সমাজের ছবিটা যদি বদলাতে হয়, তবে এই ছোটো-ছোটো অপমানগুলোর ব্যবস্থা আগে করতে হবে। কোনো বড় কিছু ঘটলে বড় আন্দোলন অবশ্যই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিদিন আমরা এমন অনেক কিছু এড়িয়ে যাই, যা এড়িয়ে না গেলে অনেক বড় ঘটনাকে ঠেকানো হয় তো যেত।

কোনো বড় মানুষের বিশেষত্বই হল, সে দুর্বলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে অপমান করে না। তার অসহায়তার সু্যোগ না নেওয়া। আর এ শিক্ষা স্কুল থেকেই শুরু হওয়া উচিৎ। শিক্ষা বিকশিত করে একজন মানুষকে। আর মাষ্টারি শুধুমাত্র যে করেই হোক আখের গোছানো শেখায়। আখের গোছানোতে কোনো খারাপ কিছু নেই, কিন্তু সারাটা জীবন শুধু আখের গুছিয়েই কাটালে গোটা মানুষ হয়ে ওঠা যায় না, এই ব্যর্থতাটা না বুঝতে পারাটা যে কী ভীষণ ব্যর্থতা তা তারা বোঝে না।

আলোচনা দীর্ঘ করে লাভ নেই। বড় মানুষের বড় দিকটার থেকে ছোটো-ছোটো দিকগুলো আমাদের কাছে অনেক বেশি আলো আনে। সে আলোয় যতটা রাস্তা নিজের জন্য আর পাশের মানুষটার জন্য আলোকিত করা যায়, এইটুকুই চেষ্টা আরকি।