Skip to main content
 
"একবার সঞ্চয় করতে আরম্ভ করলে ক্রমে আমরা সঞ্চয়ের কল হয়ে উঠি, তখন আমাদের সঞ্চয় প্রয়োজনকেই বহুদূরে ছাড়িয়ে চলে যায়, এমনি কি, প্রয়োজনকেই বঞ্চিত ও পীড়িত করতে থাকে।"
 ~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
 
 
তখন কলেজ পাস করেছি। নানান পরামর্শ নানান দিক থেকে। এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে করে ভবিষ্যতটা নিরাপদ হয়। সেই থেকে শব্দটা কানের কাছে, মাথার অলিতে গলিতে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল - 'সিক্যুরিটি' চাই, সিক্যিওর লাইফ চাই। শব্দটা আমায় ঘিরে ততক্ষণে একটা বড় ধরণের পাঁচিল তৈরি করে ফেলেছে। এমন সময় শনি দিলেন তাঁর করুণ দৃষ্টি আমার উপর। পরপর কয়েকটা ঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেল। চারদিক ধুলোঝড়ের মত অন্ধকার। সম্পূর্ণ অন্ধকারে তাও বা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে কাজ চলে যায়। কিন্তু আলো আঁধারির মিশ্রণে যে ধুলোঝড়, তাতে কিছু সঠিক ঠাহর করা দায়। পড়লাম মুখ থুবড়িয়ে। আজ সেই দিনটার জন্য অবশ্য কৃতজ্ঞতা জানাই সেই 'যে জন দেয় না দেখা' ...তাঁকে। 
একটা গান মনে পড়ল।
 
 
   পথিক সবাই পেরিয়ে গেল ঘাটের কিনারাতে
 আমি সে কোন আকুল আলোয় দিশাহারা রাতে
সেই পথ হারানোর অধীর টানে অকূলে পথ আপনি টানে
    দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে।।
 
তাই হল। গভীর বিষাদ অন্তরাত্মার আসন কুরে কুরে খাচ্ছে। সবকিছু যেন শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবে একদিন এমন একটা কিছু হল...
 
উত্তরপাড়া স্টেশানে বসে আছি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যের দিকে যাচ্ছে। পূজো ক'দিন পর। প্যাণ্ডেল বাঁধার কাজ পুরোদমে চলছে সামনে। বাচ্চাগুলো কি হুটোপাটি করছে। কিন্তু আমার মন নির্বিকার। এসি কামরার ভিতরে থাকলে যেমন বাইরের জগতের শুধু চলাফেরাটাই চোখে পড়ে, কিন্তু তার উত্তাপ, কোলাহল কিছুই কানে আসে না, আমার সেরকমই হতে থাকল। মনে হল কি হবে এভাবে বেঁচে? যদি সব স্বপ্ন এক নিমিষেই যায় গুঁড়িয়ে এত নির্মম ভাগ্যচক্রে পিষে! 
হঠাৎ আমার পাশে কি একটা নড়ে উঠল। একটু চমকে তাকিয়ে দেখি একটা বুড়ি। আমারই পাশে নানান তালগোল পাকানো অজস্র ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে পাক খেয়ে শুয়েছিল, খেয়ালই করিনি। উঠে বসল। পরনে ময়লা একটা শাড়ি। তাও দশ-বারোটা ছেঁড়া জায়গা তাতে। সামনের দিকে পাদুটো ছড়িয়ে বসতে না বসতেই কোথা থেকে দুটো কুকুর ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ওর পাশে এসে ওকে আদর করতে শুরু করল। বুড়ি বলল, "এসে গেছিস, দাঁড়া।" বলে এক ঝটকায় উঠে, অদূরেই একটা চায়ের দোকান থেকে একভাঁড় চা আর দুটো বিস্কুট কিনে আনল। একটা বিস্কুট দু'টুকরো করে কুকুর দুটোর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে, আরেকটা বিস্কুট নিজের চায়ের ভাঁড়ে ডুবিয়ে মুখে দিল। বসার ভঙ্গী একই রকম আবার। ওই কাঁথার বাণ্ডিলের মধ্যে পাদুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চা খেতে লাগল। সামনের এত মানুষের চলাফেরা, এত সাজ-পোশাকের বৈভব, সব কিছুতেই সেই নির্বিকার। তার গভীরে চোখে কোন দূরের জগতের উদাসীনতা, হাতে যে চায়ের কাপ, সেই চা খাওয়ার মধ্যে না আছে আসক্তি, না তাচ্ছিল্য। 
মনের মধ্যে বিদ্রোহ জাগল। সব চাইতে বড় মরণ শরীরের না, মানের। ভিখারীর সাথে কথা বলব? হ্যাঁ বলব। মান যাবে যে? কেউ দেখে ফেললে? পাক। ওই লাইনে শোয়ার থেকে তা কি কম ভয়ঙ্কর নয়? মন চমকে উঠল? হৃদয়ের কথা মস্তিষ্কে পৌঁছায় কি করে? 
-তোমার কে আছে?
-কেউ নেই
-খাও কি?
-ভিক্ষা করে
-ভয় করে না?
-কিসের, বদ মানুষের? না ভগবান আছেন
-ভগবান? কে সে? আছেন? বিশ্বাস করো?
-লেখাপড়া তো জানি না বাবু, তবে জানি তিনি আছেন, না হলে ওই কুকুরগুলো তো দেখলে, ওরাই বা আমায় চেনে কি করে আর আমিই বা ওদের বুঝি কি করে? ওরা তো মানুষ নয়! ওরা আমরা তুমি সব তাঁর ইচ্ছায়, সব তাঁর কেরামতি, এ মনে রাখলে শান্তি বাবু।
তার ঘর ছিল। বর মরল। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়ালো। লোকের বাড়ি কাজ করে ক'বছর কাটল। কিন্তু স্থায়ী কিছু হল না। অবশেষে এই হল তার স্থায়ী আবাস। পথ, ভিক্ষা আর ভগবানের উপর অগাধ আস্থা। কয়েকটা ট্রেন ছেড়ে বসে রইলাম। এ কি করে সম্ভব? তবে কি এই 'সিক্যুরিটি' শব্দটা এতটাই আপেক্ষিক? ওর তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। কেন? সঞ্চয় নেই বলে? মান নেই বলে? পরিবার নেই বলে? নাকি নিজের প্রতি ভালোবাসা... না তা কি করে হয়, নিজের ওপর তো তার কোনো অভিযোগ নেই! তবে আমার এত ভয়, হতাশা কেন? আমার মূল্য কি ওর থেকে অনেক বেশি? আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ কি এইভাবেই দিনাতিপাত করছে না এই অসাম্যতাপূর্ণ, অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ জগতে? তবে নিজেকে নিয়ে এতো উদ্বিগ্নতা কিসের? এ কি চূড়ান্ত স্বার্থপরতা, লজ্জার নয়? যেখানে এতগুলো মানুষ এইমাত্রার জীবন যাপন করছেন সেখানে আমি 'আমার যে কি হবে' ভেবে আকুল হচ্ছি। বিশ্বসংসারকে বাইরে ব্রাত্য করে রেখে নিজেকে বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র ঠাওরে চোখের জলের বান ডাকছি!
মনে হল যুগান্ত সঞ্চিত অন্ধকার এক নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। নিজের সাথে নিজের মুখোমুখি হতে ভালো লাগল। লজ্জা লাগল না, ক্ষোভ হল না। হাওড়া স্টেশানে নামলাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতে লাগল এই মানবসমুদ্রের আমিও তো একটা ঢেউ। আমি বিচ্ছিন্ন হলেই চূড়ান্ত ব্যর্থ। সংসারের নিজস্ব যে বিধান আছে, চলার বেগ আছে, ছন্দ আছে, তার থেকে নিজেকে ছিন্ন করে, নিজের জন্য একটা আলাদা বিধান, বেগ তথা ছন্দ তৈরি করে বাঁচার মধ্যে হয়তো একটা মদমত্ত সুখ আছে, তবে সার্থকতা নেই। সেদিন স্থির করলাম, আর নিজেকে আলাদা করে ভাবা নয়। যা হওয়ার হোক। যতটুকু চেষ্টা করার করে যাই, হলে ভালো, না হলে 'মরে যাব মরে যাব' করে বাঁচব না।
 
 
আজ যখন বহু বড়বড় সম্ভাবনা শুধু এই অলীক 'নিরাপত্তা' শব্দটার কুহক মোহে নষ্ট হয়ে যায় দেখি তখন বড় যন্ত্রণা হয়। যে অসাধারণ গাইত, সে গিয়ে সেঁধোলো ইঁদুর দৌড়ের দুর্বলতম প্রতিযোগী হয়ে। দৌড়ে দৌড়ে দৌড়টাকে অভ্যাস করল। হয়তো বা কাঙ্খিত উচ্চতা স্পর্শ করল। তারপর? তারপর গভীর বিষাদ। 'এ তো আমি চাইনি?' - কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে যে। তখন নিজেকে ভুল বোঝানো, নিজের পরের প্রজন্মকে ভুল বোঝানো, কৃত্রিম সুখে গা ভাসানো, সব রপ্ত করে ফেলতে চায়। করেও। মরে বেঁচে থাকার অভিনয় যে কি সাংঘাতিক! আসলে ওরা সফল নয় তো, সফল ব্যক্তিদের মত, এই 'মত' শব্দটা যাদের জীবনের মাপকাঠি, তাদেরই বানানো এই ইঁদুর দৌড় কনসেপ্টে পিষছে হাজার হাজার আরো দুর্বল, সুবিধাবাদীর দল। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, এরা চিরটাকাল তাদের শ্রেণীকেই বাঁচিয়ে রাখতে চায় যে করেই হোক, না হলে তাদের অস্তিত্বসংকট প্রবল হয়ে উঠবে। এরাও ট্রাপিজের খেলা দেখায়, বাঘের সাথে মজা করে, ইত্যাদি আরো অনেক কিছু করে, তবে সবই ওই জোকারের মত। আর জোকার চিরকাল জোকারই তৈরি করে।
তবে কি নিরাপত্তার কথা ভাবব না? অবশ্যই ভাবব। সাথে এটাও মাথায় রাখব নিরাপত্তাটা ব্যাঙ্কে না, সোশ্যাল স্টেটাসে না, সার্টিফিকেটে না। আসল নিরাপত্তা আমার নিজের মধ্যে, হৃদয়ে। নিজের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততায়, সততায়, মানবিকতায়, সহনশীলতায়। তাই কেউ সব হারিয়েও দাঁড়াতে পারে, আবার কেউ সব থাকতেও ভয়ে আতঙ্কে আধমরা হয়ে বেঁচে মরে থাকে।