সৌরভ ভট্টাচার্য
25 January 2019
বিতানের সবচেয়ে একা লাগে নিজেকে যখন পিয়ালীর সাথে থাকে। সে আর পিয়ালী, ঘরে কেউ নেই, এটা তার কাছে ছোটোবেলার হস্টেল জীবনের থেকেও ভয়ংকর। নিজের হাত, গলার আওয়াজ, কথা বলার সময় শব্দ খোঁজা, নিজের গায়ের রঙ, দাঁড়ানোর ভঙ্গী, পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্য, গায়ের গন্ধ - সব কিছুই অস্বস্তিকর তার নিজের কাছে সেই সময়টা। বিতানের মনে হয় সে যেন কোনো আগাম নাটকের মহড়ায় এসেছে। কিছুতেই পাঠ মুখস্থ হচ্ছে না, হাঁটাচলা কিছুই ঠিক হচ্ছে না। আগে নার্ভাস লাগত। এখন বিবমিষা লাগে। ছেড়েই চলে যেত, সমস্যা হল বিল্লুকে নিয়ে, তাদের সাড়ে তিন বছরের পুত্রসন্তান।
বিতান আর পিয়ালীর ঠিক ঝগড়া হয় না। একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলে। জমি দখলের। যখন সেটা বাহ্যিক হয়ে ওঠে তখন অবশ্য শুধু বিতানের গলা, গালাগাল, জিনিস ছোঁড়া, দাপাদাপি শোনা যায়। পিয়ালীর গলা কেউ শোনেনি আজ অবধি।
পিয়ালীর প্রথম প্রথম আজব লাগত। বিতান যেন আর পুরুষদের মত নয়। পিয়ালীর জীবনে স্বামী বিতান হলেও আগে যে সে পুরুষসঙ্গীবিহীন ছিল তা তো নয়! বিতানকে প্রথম প্রথম ভাবত ক্যাবলা, সাদাসিধা মানুষ। দিন যেতে যেতে বুঝল, সে ভুল ছিল, বিতান উদাসীন, আত্মকেন্দ্রিক। বিশেষ করে উপলব্ধি করল বিল্লু হওয়ার দেড় বছরের মাথায় অপারেশান টেবিলে শুয়ে। অ্যাবরসান করাতে গিয়েছিল। পিয়ালী বারণ করেছিল, বলেছিল প্রোটেকশান নিতে, নেয়নি।
পিয়ালীর একটা দমচাপা রাগ হয় বিতানকে একা দেখলেই। বিতানের ক্যাবলা ক্যাবলা হাবভাব দেখলে মাথাটা দপদপ করে। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঘূর্ণী নামছে মনে হয়। বিল্লুর বাবা এই মানুষটা, উফ! অসহ্য!
বিতান পিয়ালীর শরীর খারাপের ডেটগুলো খেয়াল রাখে না আজকাল। আগে রাখত। সাত বছর হল বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বড্ড বেশি সময় মনে হয়। শরীরের আকর্ষণ নেই তা নয়, পিয়ালীর ওপর নেই। মাঝে মাঝে আসে যখন তীব্রতা অমানুষিক হয়। তখন অত মন-টনের কারবার থাকে না। জাস্ট এক্সারসাইজ একটা।
বিতান আগে পার্টি করত। এখন করে না। বিল্লুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। সে খেলোয়াড় হবে। এখন থেকেই মাঠে নিয়ে যায়, দৌড় করায়। কলকাতাতেও নিয়ে যাবে পাঁচে পড়লেই। এখন থেকেই গ্রুমিং করতে হবে। বিতান বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাতে স্বপ্ন দেখে বিল্লু বিশাল ক্রিকেটার হয়েছে.. ফুটবলার... দাবাড়ু.... সাঁতারু... ফিল্মস্টার? না, বাংলায় ফিল্মের কেরিয়ারটা নেই।
বাড়ির নিয়ম, বাড়ির বউ স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে নিজে দোকানে যাবে না। ছোটো জায়গা। সব চেনা পরিচিত। শাশুড়ির আজ্ঞা। পিয়ালী মেনেই চলে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হত না। বিতান আগে থেকেই এনে আলমারিতে রেখে দিত। এখন সে সব নেই আর। পিয়ালীকে বারবার মনে করাতে হয়। সাত-আট মাস আগে এই নিয়ে কুরুক্ষেত্র হয়ে গেছে। বিতান বদলা নিয়েছে। এক বছরের ন্যাপকিন কিনে নিয়ে এল। রাখবে কোথায়? কেন তোমার আলমারিতে! মেয়ে মানুষের আলমারি আর কি কাজে লাগে!
বিতানের অসহ্য লাগে। কেন যে প্রতিমাসের এই নক্সা! আর মায়েরও হয়েছে, কেন নিজে গিয়ে কিনলে কি হয়? ওষুধের দোকানের ছেলেটা বিতানের বন্ধুর ভাই। সেই অর্ডার দিয়ে আনিয়ে দিল। একটা উচিৎ শিক্ষা হয়েছে, মায়েরও আর পিয়ালীরও।
শিক্ষাটা উচিৎ হল কিনা জানি না। তবে পিয়ালী দোকানের রাস্তাটা বদলালো। এখন তার নিজের মধ্যেই একটা বাধা শুরু হল নিজেকে নিয়ে। কিছুটা সে বুঝল। কিছুটা বুঝল না। পাড়া প্রতিবেশী বুঝল। তারা বলল, "মেয়েটা এমনিতে তো ভালোই, একটু যা উচিৎ কথা বলার বদভ্যেস। তা লেখাপড়া শিখলে মেয়েদের অমন একটু আধটু বিকার হয় বইকি। সময়ের সাথে সাথে শুধরেও যায়। না শুধরালে পস্তাবে। আরে বিদ্যাসাগরেরা যে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করল, সেকি মেয়েদের কথা ভেবে না নিজেদের বিখ্যাত করবে বলে? পুরুষ মতলব ছাড়া কাজ করে? সে যে সাগরই হোক।"
পিয়ালী যেন বুঝতে পারে এই কথাগুলোর মানে। পিয়ালীর ধর্মে মন এলো। শনি, মঙ্গল, ঝাঁটা, বিড়াল, দেবতা, উপদেবতা, দেশাচার, লোকাচার --- সব মানল। এক এক সময় তার নিয়মে শাশুড়ি পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠে বলে, বউমা আজকাল এতসব কেউ মানে না! তোমার সবতাতে বাড়াবাড়ি!
পিয়ালী অবুঝের মত তাকিয়ে থাকে। ভাবে মানুষ কি দ্বিরাচারী হয়!
বিতানের সব ছাড়াছাড়া লাগে। বিল্লু খেলতে যায় না। পড়াশোনা করে না। বিতান ক্লান্ত। পিয়ালী নিজের খেয়ালে। মা নেই। বিতানের মনে হয় কি জন্য মানুষ সংসার করে তবে? ঈশ্বরে বিশ্বাস তো শিশুদের, রাজনীতিতেও বিশ্বাস নেই। বিতান হাত দেখা শিখছে। তার আঙুলে আটটা আংটি। বিতান বুঝতে শিখেছে, ভাগ্যের একটা বিজ্ঞান থাকে। সেটা মানতেই হয়।