সৌরভ ভট্টাচার্য
11 July 2019
আমাকে ছাড়িয়ে আমি দাঁড়িয়ে। দরজায় তালা। চাবি নেই। থাকলেও নেই। হারালেও নেই। রাস্তার পাশে হলুদ আলো। যুগ-যুগান্ত ধরে জ্বলে আছে। আমিও দাঁড়িয়ে আছি নীচে। অনেকবার মৃত্যুর পরেও নড়তে চাইনি এক পা। শুনছো, আমি ভালোবাসি।
আমার বাড়ির ভিতর নেই। দেওয়ালগুলো ভেঙে গেল। সারানো হল না। বাড়ির ভিতর বাইরে সমান হল। সূর্য, চাঁদ, তারা সব আগল ভাঙা ঘরে যত্রতত্র পায়চারি করে বেড়ায়। দৌরাত্ম্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তুমি জানো আকাশের তারারা অতীত, তুমি যা দেখো তা যুগান্তরের আলো, হয়ত সেই তারাটাই এখন আর নেই। হায়, হায়, ভালোবাসা, দু'দণ্ড শান্তি দিল না জীবনকে। ছুটিয়ে খাটিয়ে ভাবিয়ে কাঁদিয়ে... থাক, শুনছো, হয়ত তুমি নেই, তারাটার মত, তবু তাকিয়ে আছি... আছি... আছি... আমার 'নেই' হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। তবু বলো, সবই কি অতীত? সব? না না না। এই দেখো, আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার পায়ের পাতার বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয়... আমি আছি... আছি... আছি...
এখন ঘাটের শেষ ধাপে ভাটার জলের ধাক্কা। জোর নেই। আবেগ আছে। ইটভাটার চিমনির ধোঁয়ায় ঢাকছে আষাঢ়ের মেঘে ঘুমন্ত আদুরে আকাশ। গঙ্গা এখন দক্ষিণমুখী। আবার হবে উত্তরমুখী। কেউ যায় না। ঘুরে ফিরে আবর্তে। তুমি কেন্দ্র। আমি ঘুরলাম। পরিধি হলাম। ব্যাস হলাম। কিন্তু কেন্দ্রে মিললাম কই? আমার যে বৃত্ত হওয়ার সাধ ছিল, তোমায় নিয়ে। বৃত্তটা কেন্দ্রবিন্দু ছাড়া যেন। শ্মশানের খাটে শুয়ে জ্যান্ত কুকুরের পরিবার। খাটটায় খানিক আগে যে এসেছিল সে বৈদ্যুতিক চুল্লীর চিচিংফাঁকে, হায় জীবন, হায় হায়, কি অমরত্বের আশা তোমার। বাউলের একতারায় বুকের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ল বেড়াল, রান্নাঘরের জানলা খোলা, অসাবধানী গৃহস্থ। সব জমানো সুখ চেটেপুটে খেয়ে গেল। শুকনো কাপড় হুড়মুড়িয়ে আসা বৃষ্টিতে গেল ভিজে। সুখের সাগরে শ্যাওলা সিঁড়ি, সাবধান মন সাবধান। কাঁকড়ার গর্ত, সাপের ছোবল। সুখের সাগরে লোভের কুমীর। ডুবল, কিন্তু উঠল না। আমি উদাসীন, শুনছো, তোমায় ভালোবেসে আমি উদাসীন। আমি গৃহহারা, অনিকেত। আমার জন্ম নেই, আমার মৃত্যু নেই, আমার আমি নেই, আমার তুমি নেই, আমার শুধু একক্ষেত পাকাধানে বসন্তের হাওয়া...ওই দোলা লাগল... ওই... আমি নুয়ে পড়ছি... মাটির গন্ধে মিশে যাচ্ছি.... ওই... ওই.... আমার কেঁচোর গায়ের মত ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে আবেগ... তার পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ঝলকে ওঠার সাধ, তোমায় ভালোবেসে... শুনছো... শুধু তোমায় ভালোবেসে... আমি মরছি... আমি মিশছি... আমি নেই... তারা নেই... সূর্য নেই... শুধু আলো... আরো আলো.... কে যেন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল? কে কে কে?.... এই যে আমি... তুমি কই... কই... কই... আমার বিষাক্ত হৃদয় নীলকন্ঠ... শুধু তোমায় ভালোবেসে... তুমি নেই।