Skip to main content
 
 
       রান্নাঘরে ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়াটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে নাতুয়ার সকালের বাতাসে মিশছে। সখ্যতা তৈরি হচ্ছে। নাতুয়া ধূপগুড়ি থেকে বেশ কিছুটা গিয়ে চা-বাগান ঘেরা ছিমছাম একটা গ্রাম। অল্প অল্প ঠাণ্ডা বাতাস আসছে নদীর দিক থেকে। খরস্রোতা সরু একটা নদী কয়েক পা এগোলেই। 
       গতকাল বৌভাত ছিল। এক আত্মীয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রিত আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধুরা। যে আত্মীয়তা রক্তের সম্পর্কের না, হৃদয়ের সম্পর্কে তৈরি। ছোটো একফালি উঠোন। তার ডানদিকে দুটো ঘর, সামনে দুটো ঘর, উল্টোদিকে রান্নাঘর। সেই একফালি উঠোনে কয়েকটা চেয়ার টেবিল পাতা। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। পুরুষেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে চেয়ারে বারান্দায় বসে গল্পে মশগুল। দীর্ঘরাত জাগার ক্লান্তি চোখেমুখে। রান্নাঘর থেকে যেন শতকণ্ঠের আওয়াজ। 
       সম্পর্কের দোহাইয়ে যারা কাকিমা, জেঠিমা, ঠাকুমা, পিসীমা তারা সব খাওয়ার জোগানে ব্যস্ত। এক কাকিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "ঘুম হয়েছিল রাতে?" হেসে বললেন, “তাই কি হয়? এতগুলো লোক, কোনোরকমে মাটিতে পিঠ ঠেকিয়ে গল্প করতে করতেই তো ভোরের আলো ফুটল। ঠাকুর দিয়ে এসেই ভাত চাপালুম, অনেকে সকালের ট্রেন ধরবে যে”...
       আমি চেয়ার নিয়ে রান্নাঘরের বাইরের বারান্দায় বসে সে কর্মযজ্ঞ দেখতে লাগলুম। জানি বাড়ির পিছনেই নদী, বাঁকা বাঁকা তার শরীরের উপর রোদ এসে ঝলমলে জলে কলতান তুলতে তুলতে চলেছে; জানি বড় বড় সেগুন, শাল, নানা অজানা গাছের ছায়া ঘেরা পথে, গ্রামের নিঃশব্দতায় একটা মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে; জানি মাঠের উপর চরা গরুর পালের দিকে তাকিয়ে কোনো একটা গাছের ছায়ায় আড় হয়ে শুয়ে কোনো রাখাল, ছিপ ফেলে বসে কোনো জেলে। কিন্তু সে সব থাক। নির্জনতার চাইতে এই আমার ঢের পাওয়া। এই যে এতগুলো মানুষ আমার সামনে, তেমনভাবে কেইই বা পরিচিত, মাত্র কয়েকজন ছাড়া? কিন্তু তাতে কি, যে যুবক এসে জিজ্ঞাসা করে গেল, "দাদা তোমার কফি লাগবে?" তাকে চিনি না। সে মাধ্যমিকে উচ্চমাধ্যমিকে কত পেয়েছিল জানি না। সে বিজ্ঞান না কমার্সের ছাত্র জানি না। সে যদি গ্রাজুয়েশান করছে তো কিসে করছে জানি না... এসব কিছুই জানতে চাইনা। যেটুকু জানলে একটা মানুষকে জানা যায় তার চাইতে এত বেশি জানতে চাই আমরা যে আসল মানুষটা চাপা পড়ে মরে সেই অতিজানায়, মিথ্যা জানায়। আসলে বড়কে জানতে অনেক তথ্য, পরিসংখ্যান, আকার আয়তনের মাপ লাগে। মহৎকে জানতে লাগে শুধু একটাই জিনিস শ্রদ্ধা। সেই শ্রদ্ধার চোখে এমন অনেক জিনিস চোখে পড়ে যা নিজের চির অভ্যস্ত বদ্ধ ঘরের কয়েকটা জানলা আপনিই খুলে দেয়। মন বিস্মিত হয়ে বলে, আমার ঘরের কোলেই এমন জিনিস ছিল চোখে পড়েনি! হৃদয় বলে, বলেছিলাম তো! 
       একটা বাচ্চা উলঙ্গ হয়ে চারদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তাকে বললাম, "হ্যাঁ রে, তুই কোথা থেকে আসছিস?" সে হেসে বলল, "রাণাঘাট।" আমি বললাম, "সেকি তুই এতটা রাস্তা এমন ন্যাংটো হয়ে চলে এলি? ট্রেনে কিচ্ছু বলল না কেউ?" সে একগাল হেসে দৌড় দিল। আমি কারোর সাথে একটা কথা বলছি, সে সেই ভিড়ের মধ্যে আমায় খুঁজে বার করেছে। হলুদ হাফপ্যাণ্ট আর নীল একটা জামা পরে এসেছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার হাতটায় টান দিয়ে বলল, "এই দ্যাখো... এই জামাটাই তো পরে এসেছি..."
       তাকে আদর করলাম। সে হেসে ছুট দিল। ঘন্টা খানেক বাদে দেখি সে আবার তার আগের অবস্থায়, আমায় দেখে হেসে বলল, "মা চান করাতে নিয়ে যাবে ওইইইইই নদীতে... যাবে?"
       বলছিলাম না একটু আগে, আমরা মানুষকে জানি না তা নয়, এত বেশি জানি যে সহজ হতে হতে বেলা গড়িয়ে আয়ুরবি পশ্চিমে ঢলে পড়ে। চিত্তের ভাঁড়ার শূন্য, তাতে খানিক অহং-এর চিবানো ছিবড়ে। 
       খেতে বসার তোড়জোড় চলছে। আমরা কয়েকজন বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম আশেপাশের কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখব। আমরা স্নানটান করে তৈরি, কথা হয়েছে বাইরে খেয়ে নেব। কথাটা পাড়তেই বাড়ির যিনি কর্ত্রী এসে বললেন, “একেবারেই না খেয়ে যাবা? লুচি হচ্ছে একটু পরে, ভাত হয়ে গেছে, দুটো মুখে দিয়ে গেলে হত না?”
       আমি ওনার চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকালাম। সাদা চুল। মুখের মধ্যে দীর্ঘ জীবনযাত্রার লড়াইয়ের বলিরেখা। চোখের মধ্যে গ্রীষ্মের দুপুরের ভরা দীঘির টলটলে জলের মত স্নেহভরা চাহনি। আমার চারদিকে থইথই করছে লোক। ওনার রক্তের আত্মীয়। আমি না খেয়ে বেরোলে কি ক্ষতি ওনার? কিসের দুশ্চিন্তা? এর উত্তর হয় না। অনুভব হয়। বললাম, "ভাত খেয়েই বেরোবো।"
       লুচি আমার প্রিয়। এত সকালে ভাত? কেউ একজন আমাদের মধ্যে বলল। আমি বললাম, "হ্যাঁ, আমি ভাতই খাব।" এর কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু আমার মনে হল ভাতের মধ্যে যে গন্ধটা পাব, যে স্নেহটা ছুঁতে পারব, যেন লুচি সেটা দিতে পারবে না। কি অযৌক্তিক কথা না? এইটাই তো সারা জীবন ধরে দু'গালে চড় খেয়ে খেয়ে শিখছি। জীবনটা যুক্তির বাইরে এতখানি মেলা যে সেটুকু বাদ দিয়ে বাঁচার মত ক্ষতি আর নেই। কিন্তু আমিত্বটাকে পাপোসে না মুছে ঢুকতে গেলে পদে পদে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে জীবন। 
       গাড়ি ছাড়ল। আমার সম্পর্কে মাসি এসে বললেন, "এইবার শান্তি হল। এবার নিশ্চিন্তে যাও, পেটে ভাত যখন পড়ে গেছে..." আমি অবাক হলাম। অভিযোগ নেই কেন? কেন তোমরা যাচ্ছ, আমরা যাচ্ছি না? ভাবার সময় নেই। বিয়ে বাড়ির ভোজে কোন হাওড়ার আত্মীয়ের পেট খারাপ তার জন্যে মুড়ি জল; কার ট্রেন আরেকটু পরেই, তার জন্য গরম ভাত ডাল সেদ্ধ; কেউ প্যাণ্ট পাচ্ছে না... কেউ শাড়ি মেলার জায়গা পাচ্ছে না... কার বাচ্চার দুধটা কেটে গেছে... পাঠাও কাউকে বাজারে... গরুগুলোকে মাঠে ছাড়া হয়েছে?...
 
       গাড়ি নাতুয়া ছাড়ছে। রান্নাঘরের ধোঁয়াতে চোখ আটকে আমার। চোখের দৃষ্টি বাষ্পীভূত। এইটুকুতেই সব পেয়েছি। কি দেখতে যাচ্ছি? কি দেখব? সত্যিই কিচ্ছু দেখলাম না। তাকালাম শুধু। শুনলাম শুধু। কিন্তু সে সুর কই? ফিরে এসে ট্রেন আবার ধূপগুড়ি থেকে। আমি বললাম, বেকার গেলাম... কিচ্ছু ভালো লাগেনি... কিচ্ছু না...
       আমার বলাটা যেন অনেকটা প্রায়শ্চিত্তের মত শোনালো... শান্তি পেলাম...

Category