বাথরুমের দরজাটা খুলতেই কি একটা মাটিতে ছিটকে পড়ল।
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, কি একটা না, কারা দু'জন…. মৈথুনরত দুটো আরশোলা। তারা তাড়াতাড়ি বালতির পিছনে ঢুকে পড়ল।
আহত হল কি?
সঙ্গে সঙ্গে আমার বাল্মীকির কথা মনে পড়ল। এক ব্যাধ মৈথুনরত দুটো পাখিকে তীর মেরে ছিল না, ব্যস, অমনি বাল্মীকির মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সেই শ্লোক….
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ,
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্”
“ওহে ব্যাধ, যেহেতু তুমি মিলনরত এই ক্রৌঞ্চদ্বয়কে হত্যা করলে তাই জীবনে তুমি শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।”
রবীন্দ্রনাথ 'বাল্মিকী প্রতিভা'তে লিখছেন…. তারপর বাল্মীকি গেয়ে উঠছেন….
“কী বলিনু আমি! এ কী সুললিত বাণী রে!
কিছু না জানি কেমনে যে আমি প্রকাশিনু দেবভাষা
এমন কথা কেমনে শিখিনু রে।পুলকে পুরিল মনপ্রাণ,মধু বরষিল শ্রবণে,
এ কী! হৃদয়ে এ কী এ দেখি!--
ঘোর অন্ধকার মাঝে,এ কী জ্যোতি ভায়,
অবাক্!-- করুণা এ কার!”
কিন্তু আমি কী গাইব? আমি বাল্মীকিও নই, নই রবীন্দ্রনাথ।
আরশোলাদুটোকে একবার উঁকি মেরে দেখলাম। জ্যান্তই আছে। কিন্তু আমার মনে তো শান্তি এমনিতেই থাকে না, তারপর বাল্মীকির এই অভিশাপ! না মারলেও, বিরক্ত তো করেইছি। ইচ্ছা করে না হলেও, আমার হাতেই তো ঘটল ঘটনাটা।
যা হোক ব্যথিত ভারাক্রান্ত মনে নিয়ে শুলাম। তারপর যে কি হল। দেখি আরশোলা দু'জনকে নিয়ে নারদমুনি এসেছেন। বলছেন, আচ্ছা লোক তো হে বাপু তুমি…. ওই সময়ে ধাক্কা দিয়ে স্থানচ্যুত করার সাহস আসে কি করে?
আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের ইচ্ছা থাকলেও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ আরশোলা দুটো আমার দুই কাঁধে বসে আছে। আমার স্বপ্নিল মনে তখন পাণ্ডুর মুখটা ভাসছে। উফ্, ওই যে গো ঋষি কিন্দমের উপাখ্যান।
তো হল কি, পাণ্ডু বনে ঘুরছেন। হঠাৎ দেখেন দুই মৈথুনরত হরিণ। অমনি ধাঁ করে তীর মারলেন পাণ্ডু। ব্যস, এক তীরে দুই হরিণ ঘায়েল!
হায় হায়! হরিণ তো নয়। এ যে ঋষি কিন্দম তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মৈথুনরত ছিলেন। আসলে এই হরিণ নিয়ে আমাদের কাব্যে বড় গোলমাল। সে সীতাহরণই বলুন, আর এই এখন কিন্দম ঋষিই বলুন। স্বয়ং রাম, স্বয়ং লক্ষণ, স্বয়ং সীতাদেবীই হরিণরূপী মারীচকে চিনতে পারলেন না, তো পাণ্ডু বেচারা কী করেন! আমি সেই থেকে চিড়িয়াখানা, কি জঙ্গলে হরিণ দেখলে সাবধান হয়ে যাই। বলা যায় না!
তো সেই মৈথুনরত কিন্দম দিলেন আচ্ছা করে অভিশাপ পাণ্ডুকে। বললেন, তুমিও যখন স্ত্রীর কাছে সম্ভোগার্থে যাবে, ব্যস, পট করে মরবে।
এবার আমি যাই কোথায়? একদিকে বাল্মীকি, আরেকদিকে পাণ্ডু। দু'জনের অভিশাপ লাগল বুঝি। আমার স্বপ্নিল মাথায় তখন এক খেলা খেলে গেল। আমি বললুম, ওহে আরশোলারা, শুনুন, এই শাস্ত্র আপনাদের কীভাবে উপেক্ষা করেছে। হরিণ, পাখি সবারই মৈথুনকালে হত্যায় পাপের বিধান দিয়েছে। সেখানে বিজ্ঞান মতে আপনারা এত প্রাচীন হয়েও সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত, এই কৌলীন্যপ্রথার বিরুদ্ধে কিছুই কী বলার নেই আপনাদের?
আরশোলারা নড়েচড়ে বসল। নারদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই আমার মোবাইলের অ্যালার্ম বেজে গেল। উঠলাম। শয্যাত্যাগ করলাম।
তখন শৌচালয়ের জানলা দিয়ে সকালের সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে টবে ধরা জলের উপর। তার দোদুল্যমান ছায়া ছাদ আলোকিত করে লীলা করে চলেছে। আমি আরশোলা খুঁজতে গিয়ে দেখি কয়েকটা ডানা পড়ে। হায়, কী হল!
টক, টক, টক।
টিকটিকি ল্যাজ দুলিয়ে সগর্বে ছাদের আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে বলল, ম্যায় মহাকাল হুঁ।
ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, বিষ্ণু, বরাহ, মৎস, কূর্ম ইত্যাদি হয়েছিলেন। টিকটিকিই বা হতে ক্ষতি কী?
আমার পড়ার ঘরে এসে বসলাম। "নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচীন"।
জীবনে আমাদের নিমিত্ত হওয়া বইকি আর কী উপায় আছে? শোক, আনন্দ, বিষাদ, চেষ্টা, ব্যর্থতা, সফলতা... সবেরই নিমিত্ত মাত্রই তো। কতটুকু ধরে রাখা যায়, আর কতটুকুই বা ইচ্ছামত হয়? এই আরশোলাযুগলের ফেলে যাওয়া ডানাও যাবে মিলিয়ে। হায় নিষ্ঠুর মহাকাল!
নিমিত্ত ভব সৌরভ... নিমিত্ত ভব....